আহমাদ ইশতিয়াক

  ২৩ আগস্ট, ২০২১

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

মুক্তি-সংগ্রামের পালে মানবতার জাগরণ

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনের সূত্রপাত কীভাবে?

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করার মূল নায়ক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিতই পত্রপত্রিকায় খবর পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা নিপীড়ন, ধর্ষণ সমস্ত বিশ্ব বিবেকের মতো নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এদিকে ভারতের খবর শুনছেন, শরণার্থীদের সহায়তা দেওয়া ঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। ইন্দিরা গান্ধী অবশ্য বলেছেন শরণার্থীদের সমস্ত সহায়তা দেবে ভারত। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এরই মধ্যে তার দুই দফা কথা হয়েছে। পণ্ডিত রবিশঙ্কর বারবার ভাবছেন কী করা যায়। এমন সময় তার মাথায় পরিকল্পনা এলো। ভাবলেন যদি একটি কনসার্ট করা যায়। সেই কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থ পাঠানো যায় ভারতে কিংবা কোনো সংগঠনের মাধ্যমে।

তখন তার মাথায় এলো বন্ধু প্রখ্যাত গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের কথা। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে রবিশঙ্করের বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে যখন বিটলস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গান গাইতে এসেছিল। এই বন্ধুত্বই পণ্ডিত রবিশঙ্করকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত করতে সহায়তা করেছিল। জুন মাসের প্রথম দিকে লস এঞ্জেলসে রবিশঙ্কর তার বন্ধু প্রখ্যাত গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের শরণাপন্ন হলেন। জর্জ হ্যারিসনকে তার পরিকল্পনার কথা উঠিয়ে বললেন, ‘কনসার্টটি হবে দাতব্য কনসার্ট। এখানে টিকিট বিক্রি থেকে সমস্ত প্রাপ্য অর্থও শরণার্থীদের কল্যাণে ব্যয় হবে।’ তখন জর্জ হ্যারিসন এক বাক্যেই রাজি হয়ে গেলেন।

যেভাবে শিল্পীদের কনসার্টে যুক্ত করলেন জর্জ হ্যারিসন

জর্জ হ্যারিসন দুই বছর আগে ভেঙে যাওয়া বিটলসের পল ম্যাকার্টনি, রিঙ্গো স্টার ও জন লেননকে এই কনসার্টে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পল ম্যাকার্টনি সরাসরি না করে দিলেন। জন লেনন ও রিঙ্গো স্টার এক বাক্যে রাজি হয়েছিলেন, তারা আসবেন। এর আগে জর্জ হ্যারিসন তার নতুন ব্যান্ড ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ডের সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন। পিটি হাম, মাইক গিবসন, টম ইভান্স, জোয়ি মোলান্ড চার জনই রাজি পারফর্ম করতে।

জর্জ হ্যারিসন একই সঙ্গে বিখ্যাত সব সংগীতশিল্পীদের নিমন্ত্রণ করলেন। তাদের মধ্যে লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, ক্লস ভোরম্যানকে ফোন করে ও চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছিলেন। তাদের সবাই রাজি হলেন। এদিকে বিটলসের প্রতিষ্ঠাতা জন লেননকে জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন কনসার্টে যেন জন লেনন স্ত্রী ইয়োকো ওনোকেও নিয়ে আসেন। এই শর্তে রাজি ছিলেন জন লেনন। কিন্তু লেনন ইয়োকো ওনোকে বলতেই ইয়োকো ওনো নাকি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, এখন আবার ওখানে কেন! বিটলস তো ভেঙে গিয়েছে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছিল। লেনন কনসার্টের মাত্র দুদিন আগে নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে গিয়ে জর্জ হ্যারিসনকে বলেছিলেন, ‘কনসার্টে থাকার আমার তীব্র ইচ্ছা ছিল কিন্তু ইয়োকো ওনোর মন মর্জি হঠাৎ করেই পাল্টে গেল!’

জর্জ হ্যারিসন এরই মধ্যে বড় পরিকল্পনা এঁটেছেন। প্রথমে এতটা বড় পরিকল্পনা ছিল না অবশ্য। শেষমেশ জেসি এড ডেভিস, কার্ল রেডল, জিম কেল্টনার ও জিম হর্নসের নেতৃত্বে তার দল ‘হলিউড হর্নস’-এর এলান সদস্য বিউটলার, চাক ফিন্ডলে, জ্যাকি কেলসো, লু ম্যাকক্রেরি, ওলি মিচেলকেও আমন্ত্রণ করেছিলেন জর্জ হ্যারিসন।

১১ জুলাই লন্ডনে জর্জ হ্যারিসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে আগামী ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনসে আমরা একটি কনসার্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি।’

এদিকে বব ডিলান পড়লেন কিছুটা মুশকিলে। কারণ তিনি হাজার হাজার শ্রোতার সামনে গান গাইতে খানিকটা চাপ অনুভব করতেন। যদিও কোনো কনসার্টেই তার সে ধরনের সমস্যা হয়নি। এরপরও রবিশঙ্করের ধারণা ছিল তারা বেশি হলে হয়তো ২৫ হাজার ডলার সাহায্য তুলতে পারবেন। কিন্তু জর্জ হ্যারিসন ছিলেন আয়োজনের ক্ষেত্রে বড় এক নির্ণায়ক। তার একাধারে যেমন সাংগঠনিক শক্তি ছিল ঠিক তেমনি তিনি পাশ্চাত্যমহলে প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং বিটলসের কল্যাণে তো পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্তের মানুষ ছিল না যারা তাকে চিনতেন না। ফলে জর্জ হ্যারিসনের নিজের পরিচিতির সুবাদে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ হয়ে উঠল হটকেক।

২৭ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি এই কনসার্টের আইডিয়া কোথায় পেলেন?’ জবাবে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘এই আইডিয়াটি আমাদের মাথায় পরিকল্পিতভাবেই এসেছিল। কারণ প্রথাগতভাবে আমাদের বাংলার মূল শিকড় বাংলাদেশ। আপনারা সবাই এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি কিছু করার সেসব দুঃখ পীড়িত মানুষের সহায়তার জন্য।’

লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারেও বেজেছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

২৯ জুলাই লন্ডনে অ্যাকশন বাংলাদেশ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, ‘বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা নিপীড়নের বিরুদ্ধে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ও মুক্তিযুদ্ধের জনসমর্থনের জন্য আগামী ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে সম্প্রতি জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ নিয়ে করা রেকর্ডটি শোনানো হবে। যারা বিশেষ কোনো কাজে এই সমাবেশে আসতে পারবেন না তারাও যেন শরণার্থীদের জন্য অর্থ সহায়তা দেন।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের শুরুতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি, আমরা শিল্পী। আমরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুধু একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত আপনাদের বাংলাদেশের মানুষের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে সহায়তা করুক।’

কনসার্টের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় জর্জ হ্যারিসনের সংগীত পরিবেশনা দিয়ে। যেখানে জর্জ হ্যারিসন কয়েক মাস আগে প্রকাশ পাওয়া অ্যালবামের জনপ্রিয় গান ওয়াহ-ওয়াহ পরিবেশন করেন। এরপর একে একে সামথিং, দ্যাটস দ্য ওয়ে গড প্ল্যানড ইট ও ইট ডোন্ট কাম ইজি পরিবেশন করা হয়। জর্জ হ্যারিসনের পর রিংগো স্টার, লিওন রাসেল, বব ডিলান, বিলি প্রিস্টন সংগীত পরিবেশন করেন। এদিকে সবার মাঝেই অনেকটা ভ্রমণ ক্লান্তি ছিল। কারণ অনেকে বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন আবার তেমন মহড়ারও সুযোগ পাননি তারা। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের প্রতি আবেগ, সহানুভূতি আর বিক্ষোভ। এর ফলে শ্রোতাদের মধ্যেও ছিল অন্য ধরনের এক আমেজ।

বেলা আড়াইটায় শুরু হওয়া কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মূল অনুষ্ঠান পর্দা নেমেছিল রাত ৮টায়।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে কত অর্থ পাওয়া গিয়েছিল

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কনসার্ট থেকে প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার সংগৃহীত হয় যার পুরোটাই ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সিডি ও ডিভিডি থেকে প্রাপ্ত অর্থও ইউনিসেফের ফান্ডে জমা করা হয়েছিল। তবে দাতব্য বিষয়টিকে শুরুতে গুরুত্ব না দেওয়ায় কর মওকুফ হয়নি এই অর্থের। এর ফলে তহবিলের করের টাকাগুলো প্রায় ১১ বছর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংস্থার দখলে ছিল। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ত্রাণ হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কেন সব ছাপিয়ে যাবে

মুক্তি সংগ্রামে শিল্পীরাও যে কতখানি সহায়তা ও বিশ্ব সহানুভূতি জাগাতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে গণমানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছিল বাংলাদেশে চলা ইতিহাসের সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান। শরণার্থী শিবির থেকে ভেসে আসা শিশুর আর্তনাদ সংগীতের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্ব মানবতার দুয়ারে। দাতব্যের জন্য যে সংগীতের মাধ্যমেও সহায়তা করা যায় তার সূচনা হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ দিয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close