reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০২ আগস্ট, ২০২১

বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘নৌকা’

নৌকার ইতিকথা

প্রাচীন বাংলার অন্যতম কেন্দ্র চন্দ্রকেতু গড়ের কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। এই চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া বেশ কিছু পোড়ামাটির সিলে নৌকার উল্লেখ আছে। আবার দুটো নৌকার নামও পাওয়া গেছে সেখানে। একটা হলো ‘এপ্য’ বা এপ্পগ অন্যটা ‘জলধিসক্ল’ (জলধিশত্রু)। জলধিশত্রুটা ছিল সম্ভবত যুদ্ধজাহাজ। খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকের পেরি প্লাসের বিবরণীতেও এপ্পগ নামের জলযানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। মনসা মঙ্গল ও চন্ডী মঙ্গলেও বাংলা অঞ্চলে নদীপথ ও সমুদ্রপথে চলাচলে উপযোগী দাড়-টানা পণ্যবাহী জলযান নৌকা বা ডিঙার কথা আমরা একাধিকবার খুঁজে পাই।

বিভিন্ন রকমের নৌকা

গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে। যেমন ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রি, সওদাগরি, ইলশা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, বেদে বা সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, বৌচোরা নৌকা, লক্ষ্মীবিলাস, গন্ডীবিলাস, খেয়া নৌকা, বাইচের নৌকা। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিছু আবার একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর বাকিগুলো এখন জাদুঘরে। একই সঙ্গে কমে যাচ্ছে মাঝিমাল্লা ও নৌকা তৈরির কারিগরের সংখ্যাও। এগুলোর মধ্যে কিছু নৌকার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদত্ত হলো

সাম্পান : ‘সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে যাই’ রফিক আজাদের এই কবিতার লাইনের মতোই এ দেশের লোকগীতি ও সাহিত্যের পরতে পরতে এই সাম্পানের উল্লেখ আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নৌকার মধ্যে সাম্পান সবচেয়ে পরিচিত। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান। চট্টগ্রাম আর কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। এই নৌকাগুলোর সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো, পেছনটা থাকে সোজা। সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ শব্দ, যা সাম (তিন) এবং পান (কাঠের টুকরো) থেকে উদ্ভব। আভিধানিক অর্থ ‘তিন টুকরো কাঠ’। একজন মাঝি চালিত নৌকাটি মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো। বড় আকারের সাম্পানও দেখা গেছে, যাতে সাতজন মাঝি আর তিনকোনা আকারের তিনটি করে পাল থাকত।

বজরা নৌকা : আগের দিনে বাংলার জমিদার এবং বিত্তশালীদের নৌভ্রমণের শখের বাহন ছিল বজরা। এতে খাবার-দাবার ঘুমানোসহ নানা সুবিধা থাকত। কোনোটাতে পালও লাগানো হতো। এতে চারজন করে মাঝি থাকত। যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতির কারণে বহু আগে এই নৌকার কদর কমেছে।

ময়ূরপঙ্খী : প্রাচীন কালে রাজা-বাদশাহদের শৌখিন নৌকার নাম হলো ময়ূরপঙ্খী। এর সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ময়ূরপঙ্খী। নৌকাটি চারজন মাঝিকে চালাতে হতো। এই নৌকায় থাকত দুটো করে পাল। ১৯৫০ সালের পর থেকে একেবারেই বিলুপ্ত এটি।

ডিঙি নৌকা : সবচেয়ে পরিচিত নৌকা হচ্ছে ডিঙি। যারা নদীর বা হাওর-বাঁওড়ে তীরে বাস করে, তারা নদী পারাপার, মাছ ধরা ও অন্যান্য কাজে এই নৌকাটি ব্যবহার করে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মধ্যে এতেও পাল লাগানো হয়। এখনো গ্রামগঞ্জে ডিঙির দেখা মেলে।

ডোঙা : গোড়ালিসহ তালগাছ দিয়ে তৈরি ছোট নৌকা বিশেষ। এটি তালের নাও বা কোন্দা নামে পরিচিত। ডোঙা বেশ টেকসই কিন্তু প্রস্থতা এতই কম যে এতে খুব বেশি মানুষ বা মালামাল বহন করা যায় না। একটু বেসামাল হলে ডোঙা উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তাল গাছের কোন্দা সহজে পচে না বলে ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।

পালতোলা পানসি : নৌভ্রমণে দূরে কোথাও যাওয়ার একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি। সম্রাট আকবরের আমলে এ নৌকায় করে জমিদাররা বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে যেতেন। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলে নাইওরি বহনে এই নৌকার জনপ্রিয়তা ছিল। এই পানসীতে চড়ে মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালি, মুর্শিদী আর মারফতি গান গেয়ে মন কেড়ে নিত যাত্রীদের। বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে এটি প্রচুর দেখা যেত। গ্রামগঞ্জের নৌপথে চলাচলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার স্থান দখল করে নেওয়ায় এর চাহিদা এখন আর নেই।

ছুঁইওয়ালা বা একমালাই : পালতোলা পানসির মতো ছুঁইওয়ালা একমালাই ছিল দূরপাল্লার নৌকা। আজও এর দেখা মেলে। বরিশালের দুশুমি গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাসহ উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারের সদস্যরা ছুঁইওয়ালা নৌকার মাঝি হিসেবে বাপ-দাদার এ পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

কোসা : বর্ষাকালে চরাঞ্চলে বা বিলে ডোঙা দেখা যায়। অন্যান্য নৌকার মতো এর গলুইয়ের কাঠ বড় থাকে না। অঞ্চল বিশেষে এর আকার ছোট বড় দেখা যায়। কোষা মূলত পারিবারিক নৌকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাটবাজার, স্বল্প দূরত্বে চলাচলের কাজে লাগে। একটি আদর্শ কোষা নৌকাতে আটজনের মতো যাত্রী বহন করা যায়। সাধারণত কোষাগুলোতে ছই থাকে না। কোষা বৈঠা দিয়ে চালানো হয়। তবে অগভীর জলে লগি ব্যবহার করে চালানো যায়।

গয়না নৌকা : মাঝারি বা বড় আকারের গয়না নৌকা মূলত যাত্রী পারাপারের কাজেই ব্যবহার করা হতো। এর ওপর বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচার ছাদ থাকে। একসঙ্গে প্রায় ২৫-৩০ জন যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকাটির।

ইলশা নৌকা : ইলিশ মাছ আহরণে জেলেরা এই নৌকা ব্যবহার করে থাকে বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এসব নৌকাও পাল লাগানো থাকে।

বাতনাই নৌকা : দক্ষিণাঞ্চলে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত নৌকা বাতনাই, যা পদি নামেও পরিচিত। এই নৌকাগুলো চালাতে ১৭ থেকে ১৮ জন মাঝি লাগত। এতে ১৪০ থেকে ১৬০ টন মাল বহন করা যেত। এই ধরনের নৌকায় থাকত বিশাল আকারের চারকোনা একটি পাল। যান্ত্রিক নৌকার ব্যবহারের কম খরচ ও কম সময় লাগে বলে এ নৌকার ব্যবহার কমে গেছে। এসব নৌকা এখন আর বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায় না।

ঘাষী : ভারি এবং বেশি ওজন বহন করার উপযোগী নৌকা হল ‘ঘাসী নৌকা’। এটি মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে এখন আর ঘাষী নৌকা দেখা যায় না।

মলার : পাবনা অঞ্চলে এক সময় তৈরি হতো মলার নৌকা। এটাও মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো। ১২ থেকে ৫৬ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম মলার নৌকায় পাল থাকে দুটি, দাঁড় ছয়টি। এ ধরনের নৌকাও এখন বিলুপ্তির পথে।

বালার নৌকা : কুষ্টিয়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌকা ছিল বালার। এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে এই নৌকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই নৌকাগুলো আকারে বড় হয়, যা দৈর্ঘ্যে ১২ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বৈঠা বায় ১০ থেকে ১২ জন মাঝি। এ নৌকায় পাল থাকে দুটো।

সওদাগরি নৌকা : ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য সওদাগররা এই নৌকা ব্যবহার করে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। এসব নৌকায় অনেক লোক বহন করার ক্ষমতা ছিল। এতেও পাল লাগানো হতো। যা এখন বিলুপ্ত।

বাচারি : বাচারি নামের নৌকাটিও বাণিজ্যিক নৌকা ছিল। ৪০ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম বাছারি গত কয়েক দশক আগেই বিলুপ্তির পাতায় চলে গেছে।

পাতাম : পাতাম এক ধরনের যুগল নৌকা। দুটি নৌকাকে পাশাপাশি রেখে ‘পাতাম’ নামক লোহার কাঠাটা দিয়ে যুক্ত করে এ যুগল নৌকা তৈরি করা হয়। একে অনেক সময় ‘জোড়া নাও’ বলা হয়। এ নৌকা মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে মাঝি ছাড়া চারজন দাঁড় টানা লোক থাকে। এতে একটি পাল খাটানোর ব্যবস্থা থাকে। এক সময় এই নৌকা সিলেট ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে দেখা যেত। এখন বিলুপ্তপ্রায়।

বাইচের নৌকা : নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবন ঘনিষ্ঠ ছিল যে, এই নৌকাকে ঘিরে অনেক মজার মজার খেলা হতো। নৌকাবাইচ এখনো একটি জনপ্রিয় খেলা। বর্ষাকালে সাধারণত এ খেলার আয়োজন করা হয়। বাইচের নৌকা লম্বায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রতিযোগিতার সময় আকার ভেদে ২৫ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতে পারে। এসব বাইচের নৌকার আবার নাম দেওয়া হতো। যেমন পঙ্খিরাজ, দ্বীপরাজ, সোনার তরি প্রভৃতি। এখনো মাঝে মাঝে দেখা মেলে।

শ্যালো নৌকা : বিশ শতকের শেষে নব্বইয়ের দশকের দিকে বাংলাদেশের নৌকায় মোটর লাগানো শুরু হয়। এর ফলে নৌকা যান্ত্রিক নৌযানে রূপান্তরিত হয়। পানি সেচে ব্যবহৃত শ্যালো পাম্পের মোটর দিয়ে জলে এই নৌকা।

বেদের নৌকা : বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে সম্প্রদায়। কথিত আছে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সঙ্গে এরা ঢাকায় আসে। সে সময় তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তার পর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যাদের নৌকাতেই ঘরবাড়ি, নৌকাতেই বসতি। তাই নৌকা এদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসার উদ্দেশে এরা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে পরিভ্রমণ করে। নদীনির্ভর বাংলাদেশে নৌকা বেদেদের বাহন। তারা ছোট সাইজের ছুঁইওয়ালা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। সাধারণভাবে এ নৌকাকে বাদিয়া-বাইদ্যা বা বেদের নৌকা নামে পরিচিত।

গ্রামীণ নৌকা জীবনে এসেছে যান্ত্রিকতা। এ যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে নৌকা। এখন আর মাঝিকে গুণ টেনে নৌকা চালাতে হয় না। সবকিছু এখন শুধুই স্মৃতি।

তথ্যসূত্র : সংগৃহীত

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close