রেজাউল করিম শামীম
খাদিশিল্প : কুমিল্লার ঐতিহ্যের ধারক
কুমিল্লা, বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদগুলোর অন্যতম। এটি অবিভক্ত ভারতের স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের একটি অংশ। বর্তমানে কুমিল্লা নামে জেলাটি কিছুকাল আগেও চাঁদপুর আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে ছিল একটি বৃহৎ জেলা। কুমিল্লা, স্বাধীন দেশের অংশ হলেও ঐতিহ্যগত কারণেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অলিখিত বন্ধন হিসেবেই যেন চিহ্নিত হয়ে রয়েছে এর নাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশি আন্দোলনের যে ডাক দিয়েছিলেন, সেখানে হাতে কাটা সুতোয় বোনা খদ্দরে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মহাত্মা গান্ধী সে সময় নিজে কুমিল্লা এসে খদ্দরে প্রসারে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। তারই স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে এখনো কুমিল্লায় গান্ধীর আশ্রম ‘অভয় আশ্রম’ নামে টিকে আছে।
অন্যদিকে, কালের পরিক্রমায় কুমিল্লা আর ত্রিপুরায় খদ্দরের তৈরি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী জানগণের কাছে এখনো সমাদৃত। তবে শুরু থেকেই বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কুমিল্লার খদ্দর বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায় ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নিতে পেরেছে। তবে এর জন্য অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। আধুনিকতার চাহিদা পূরণে, হাতে তৈরি সুতোয় আর তাঁতে বোনা কাপড়ের প্রতি আকর্ষণ কমতে শুরু করেছিল। আর তার নেপথ্যে ছিল অনেক কারণ। মোটা দাগে যেসব সমস্য চিহ্নিত হয়ে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রযুক্তির সহজ প্রাপ্যতায় সবকিছুই যান্ত্রিকতায় দ্রুতই রূপান্তর ও প্রসার ঘটতে থাকে। এতে উৎপাদন ব্যয় যেমনি হ্রাস পায়, তেমনি বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সুতো তৈরির তুলা, রং সর্বোপরি শ্রমসাধ্য তাঁত পেশার কর্মীর অভাব খদ্দরসামগ্রী উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে। ফলে সৃষ্টি হয় নানা সংকট। তারপরও থেমে থাকেনি খদ্দরের অগ্রযাত্রা। কুমিল্লার হাতেগোনা যে কজন বনেদি ব্যবসায়ী খদ্দরকে জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন তারাই খদ্দরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতা আর শিল্পের মিশেল ঘটিয়েছেন। কুমিল্লা ছাড়িয়ে খোদ রাজধানীসহ ছড়িয়ে দিয়েছেন আধুনিক খদ্দরের সৌরভ। আর তারই ধারাবাহিকতায় বিবি রাসেলের মতো খ্যতিমান ব্যক্তিত্ব কুমিল্লার খদ্দরকে নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক পরিম-লে।
অন্যদিকে, যোগাযোগব্যবস্থার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন রাজ্য ত্রিপুরা, খদ্দরের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। তবে অধুনা কুমিল্লার সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায়, ত্রিপুরায় খদ্দরের অবস্থাও বিকাশমান ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর কুমিল্লার সঙ্গে স্থল ও নৌপথে যোগাযোগব্যবস্থা চালু হওয়ায় এই বিকাশ হয়েছে দ্রুততর। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার সুবাধে, কুমিল্লার সঙ্গে ত্রিপুরার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্থানীয় নাগরিকদেরর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের আদান-প্রদানও।
সেই অগ্রগতির পথ ধরে কুমিল্লা খদ্দরের চাহিদা ত্রিপুরাসহ আশপাশের অন্যান্য রাজ্যেও সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ তথ্য জানা যায় কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পুরোনো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার বনেদি এলাকা হিসাবে পরিচিত রামনগরসহ বিভিন্ন বিপণিবিতান এলাকায় বেশ কিছু বুটিক ও ফ্যাশন হাউস গড়ে উঠেছে। সেখানে এখন কুমিল্লার খদ্দরের পোশাক-পরিচ্ছদর স্থানীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সেখানকার তেমনি একটি প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউসের নাম ‘ডিজাইনার বুটিক’। এর স্বত্বাধিকারী হলেন একজন সুশিক্ষিত নারী। নাম নিবেদিতা চক্রবর্তী। বিবাহিতা হলেও তিনি নিজেকে শুধু গৃহকর্মের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন আর শৈল্পিক সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন তার ফ্যাশন হাউসটি। সেখানে নিবেদিতা, তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করে চলেছেন মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ। ডিজাইনের ভিন্নতার কারণে তার এই ফ্যাশন হাউস অল্প সময়ের মধ্যেই সবার কাছে হয়ে উঠেছে বেশ সমাদৃত। যার ফলে তিনি সেখানে এখন নতুন করে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটও খুলেছেন। অন্যান্য কাপড়-চোপড়ের পাশাপাশি কুমিল্লা খদ্দরের তৈরি শাড়ি, ব্লাউজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পোশাক তৈরি করেছেন।
কুমিল্লার স্থানীয় বনেদি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললেই দেশ ও দেশের বাইরে খদ্দর পণ্যের চাহিদার বিষয়টি উঠে আসে। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলোর মধ্যে ‘খাদি ঘর’ অন্যতম। এর বর্তমান স্বত্বাধিকারী কান্তি বাবু একজন উচ্চশিক্ষিত কাপড় ব্যবসায়ী। পারিবারিকভাবে খদ্দরের ব্যবসাপরম্পরায় তিনি এখনো খদ্দরকে ধরে রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, দেশজুড়ে আজ খদ্দরের যে রমরমা ভাব তার পেছনে রয়েছে ওনার মেধা, শৈল্পিক চেতনা ও খদ্দরের প্রতি মমত্ববোধ সর্বোপরি শ্রমের সমন্বয়। এ ব্যাপারে আলাপকালে কান্তি বাবু জানান, যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর হওয়ায়, আগরতলা ও তার পাশাপাশি অন্য রাজ্যগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে লোকজন এখন কুমিল্লা আসেন বেড়াতে অথবা অন্যান্য কাজে। তারা যাওয়ার পথে অবশ্যই খদ্দরের তৈরি নানা সামগ্রী কিনে নেন। এভাবে সেখানে কুমিল্লা খদ্দরের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
একইভাবে কুমিল্লার অপর একটি প্রসিদ্ধ খদ্দরের প্রতিষ্ঠান ‘খাদি ভবন’। এর স্বত্বাধিকারীদের একজন সানাই দাসগুপ্ত। তিনি জানান ত্রিপুরায় খদ্দরের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে ত্রিপুরা ছাড়াও পাশাপাশি অন্য রাজ্যগুলোতেও সৃষ্টি হচ্ছে খদ্দরের বাজার। কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহের ক্ষেত্রে কাস্টমসসের নানা জটিলতা আর সুতো ও রং প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বলেন, ত্রিপুরার রামনগরে ডিজাইনার বুটিকস নামের একটি ফ্যাশন হাউসে তিনি প্রথম খদ্দরসামগ্রী সরবরাহ করেন। ওই হাউসের সাফল্যে সেখানে এখন অনেক দোকান গড়ে উঠেছে, হচ্ছে মেলাও। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারও বিভিন্নভাবে খদ্দরের অগ্রগতিতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। তিনি আশা করেন সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে শুধু ত্রিপুরাতেই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও এর বাজার গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে দুদেশের সীমান্তের পাশাপাশি জেলার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, সোহার্দ ও ঘনিষ্ঠতা যে বৃদ্ধি পাবে তাতে সন্দেহ নেই। কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা আধুনিক মার্কেটগুলো তো বটেই, এর বাইরেও আনাচে-কানাচে সব জায়গায় সারিসারি বিভিন্ন নামের খাদি কাপড়ের দোকানপাট দেখতে পাওয়া যায়। খদ্দরের চাহিদা বৃদ্ধিই এর প্রমাণ। কিন্তু খদ্দরের এই রমরমা অবস্থার অন্য একটি কারণ হলো কুমিল্লার বাইরেও এর সীমাহীন চাহিদা। তবে, খদ্দর কিন্তু শুধুই কাপড়ের পণ্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর দৃঢ় অঙ্গীকার। ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে কুমিল্লার কারিগর আর ব্যবসায়ীদের খদ্দরের প্রতি বংশপরম্পরায় যে মমত্ববোধ রয়েছে, রয়েছে দায়বদ্ধতা তারই ধারাবাহিকতা কুমিল্লা খদ্দরের পীঠস্থান হিসেবে সরকারি স্বীকৃতিও যে তাদের প্রাপ্য তা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের স্মরণে থাকাও জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক
"