reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৫ জুলাই, ২০২১

ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা

অবস্থান বিচারে বাংলাদেশ কতটা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে? আর এ বিষয়ে কী করণীয়? তা নিয়েই আজকের আয়োজন

বাংলাদেশ কতটা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে : সামগ্রিকভাবে কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে তা জানতে হলে বাংলাদেশ ও তার আশপাশের ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বদ্বীপ, যা কি না যুগ যুগ ধরে পলি প্রবাহের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। অনেক সময় একে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ নামেও অবিহিত করা হয়। অবস্থানের বিচারে এই বদ্বীপের অবস্থান তিনটি প্লেটের সংযোগস্থল। ১. উত্তরে ইউরেশিয়ান (ইউরোপ এবং এশিয়া) প্লেট। ২. পূর্বদিকে মিয়ানমার বা বার্মা প্লেট এবং ৩. ভারতীয় প্লেট যার ওপরই বাংলাদেশ অবস্থিত।

এটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। শুধু বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের দিকে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর রয়েছে বিশাল ডাউকি চ্যুতি, যা কিনা শিলং মালভূমির কারণে গঠিত হয়েছে। শিলং মালভূমির মনোরম পাহাড়পুঞ্জ আমাদের মন কেড়ে নিলেও যেকোনো সময় এটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, শিলং এবং আশপাশে প্রতিনিয়ত ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে, যা কি না আমরা সব সময় টের পাই না। এই ছোট ছোট ভূমিকম্প আমাদের জানান দিচ্ছে, শিলং ও আশপাশের এলাকায় অধিক পরিমাণে চাপ সঞ্চিত হচ্ছে, যা কি না যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে এবং তা হবে আমাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ।

বাংলাদেশের পূর্বদিকে উত্তরে সিলেট থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়পুঞ্জ। অনেকেরই জানা নেই, এই পাহাড়পুঞ্জ মূলত ভারত ও মিয়ানমার প্লেটের সংঘর্ষের ফলে গঠিত হয়েছে কোটি কোটি বছর ধরে। অনেক ছোট এমনকি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয় প্রায়ই এই অঞ্চলে। ধারণা করা হয়, এক বিশাল চ্যুতি চট্টগ্রাম পাহাড়ের সমান্তরালে গিয়ে দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে সুন্দা চ্যুতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে একটু উত্তরে গেলে তো কথাই নেই, বিশাল হিমালয় পর্বতমালা যা কি না তৈরি হয়েছে ভারত এবং ইউরোপ প্লেটের সংঘর্ষে। বাংলাদেশ যেহেতু পলি দ্বারা গঠিত যা কি না ভূকম্পনকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে ক্ষতির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের এবং গঠনের বিচারে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যা কি না ভূমিকম্পের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিতে : পরের আলোচনা থেকে এটা অন্তত জানতে পারি, বাংলাদেশের উত্তরে শিলং মালভূমির পাদদেশের অঞ্চলগুলো এবং পূর্বদিকে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অঞ্চলগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। বাংলাদেশের ‘ঝুঁকি মানচিত্র’ থেকেও সেটা দেখা যায়।

সাম্প্রতিককালে নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে নেপালসহ পুরো অঞ্চলে যে কম্পন অনুভূত হয়েছে, তার একটা মানচিত্র প্রকাশ করেছে টঝএঝ. এই মানচিত্র থেকেও দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলসমূহে চএঅ (Peak Ground Acceleration) সবচেয়ে বেশি। ঢাকার অবস্থানের বিচারে এখানে চএঅ মধ্যমানের হলেও এর ঝুঁকি একেবারে কম না। বিশেষ করে এর আশপাশে গত কয়েক বছর ছোট থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অন্তত তাই বলে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার আশপাশে রয়েছে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি চ্যুতি (fault)। যা কিনা ঢাকাকে যেকোনো সময় বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

ঢাকার উত্তরে বিস্তৃত টাঙ্গাইল অঞ্চলে রয়েছে মধুপুর চ্যুতি (Madhupur fault)। এই মধুপুর চ্যুতিতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকার জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে। ঢাকার দক্ষিণ-পূর্বদিকে অর্থাৎ চাঁদপুরের মেঘনা মোহনা অঞ্চলে গত কয়েক বছর ধরে ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে, যা কি না বড় কোনো ধরনের ভূমিকম্প হওয়ারই ইঙ্গিত।

ধারণা করা হয়, ঢাকার আশপাশের নদীগুলোও চ্যুতির ফলে তৈরি হয়েছে, অবশ্য এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। শুধু তা-ই না, ঢাকার মাটি থেকে যে হারে খাবার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে পানির স্তর দিনে দিনে নিচে নেমে যাচ্ছে, যা কি না ঢাকার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি ছোট মাত্রার ভূমিকম্পেও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

যদিও বাংলাদেশ এত বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে এখনো বাংলাদেশের সঠিক ‘ঝুঁকি মানচিত্র’ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে যে ‘ঝুঁকি মানচিত্র’ আছে তাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের চ্যুতির ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। শুধু তা-ই না সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছোট থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যদি রিক্টার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প মধুপুর চ্যুতিতে আঘাত হানে তাহলে ঢাকা শহরের অন্তত ৭২ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা কি না মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়বে। আনুমানিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে প্রায় ৬ হাজার মার্কিন ডলার। CDMP (Comprehensive Disaster Management Program)-এর তথ্য মতে, এ ধরনের একটা ভূমিকম্প পুরোপুরি ঢাকার ২৫০টি হাসপাতালকে ক্ষতি করবে। এই হিসাব মতে, ভূমিকম্পের এক দিন পর মাত্র ৪১ শতাংশ হাসপাতালের বেড চিকিৎসা দেওয়ার উপযোগী থাকবে। এক সপ্তাহ এবং ৩০ দিন পর এর অবস্থা দাঁড়াবে যথাক্রমে ৫৪ এবং ৭২ শতাংশ।

শুধু তা-ই না, ঢাকায় সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হবে মারাত্মকভাবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে Disaster Risk Reduction Approaches in Bangladesh বইটি পড়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে ভূমিকম্প বিষয়ে শিক্ষাও তেমন পর্যাপ্ত নয়। মাত্র তিন থেকে চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব পড়ানো হয়। ভূতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে দেখেছি ভূমিকম্প সম্পর্কে নামমাত্র পড়ানো হয় মাঝে মাঝে তাও হয় না। অবশ্য এর কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকজন আছে যারা ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করেন। তার মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো ভূমিকম্প সঠিকভাবে পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই বলেই চলে। বাংলাদেশ কিংবা আশপাশে যেকোনো মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার পর রিকটার স্কেলে এর তীব্রতা জানতে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূতাত্ত্বিক সংস্থা টঝএঝ-এর দিকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে কী করা যেতে পারে : সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অতি দ্রুত, যা করা দরকার তা হচ্ছে বাংলাদেশের ‘ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র’ তৈরি করা। কারণ এই মানচিত্রই বলে দেবে বাংলাদেশের কোথায় কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

শুধু তা-ই নয়, কীভাবে আমাদের বাসাবাড়ি তৈরি করতে হবে তারও নির্দেশনা থাকবে। এজন্য অবশ্য আমাদের ছোট ভূমিকম্পগুলো কোথায় হচ্ছে তা শনাক্ত করতে হবে প্রথমে। এর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে চ্যুতির অবস্থান সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারব, যা কি না ‘ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র’ তৈরি করতে সাহায্য করবে। ছোট ছোট ভূমিকম্পের অবস্থান শনাক্ত করতে অনেক বেশি ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করতে হবে। যদিও এই যন্ত্রগুলোর দাম অনেক বেশি। এজন্য অবশ্য বাইরের কোনো দেশের ভূমিকম্প গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি নিয়ে অধিক গবেষণা, যা হচ্ছে না বললেই চলে। মোট কথা হচ্ছে, আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। তা না হলে একটা বড় মাপের ভূমিকম্প হলে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমাদের দেশ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি।

ভূমিকম্পের সময় করণীয় : প্রথমে আমাদের যেদিকে নজর দিতে হবে তা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে ভূমিকম্প সম্পর্কে শিক্ষিত করা। বেশির ভাগ লোকজনই জানে না ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে! সাম্প্রতিক সময়ে নেপাল ভূমিকম্পের প্রভাব বাংলাদেশও অনুভূত হয়। এ সময় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে, যার ফলে সবাই একসঙ্গে ছোটাছুটি করে ঘর বা অফিস থেকে বেরিয়ে পরে। ফলে অনেকে এমনিতেই আহত হয়।

ভূমিকম্পের বিষয়ে যেহেতু পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। তাই যতটা সম্ভব আতঙ্কিত না হয়ে ঘর বা অফিসে থাকলে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। আর যতটা সম্ভব নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সাবধানতা আগেই নিয়ে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার Federal Emergency Management Agency অমবহপু দ্বারা নির্ধারিত নিচের সাবধানতাগুলো পালন করা যেতে পারে।

ঘর বা অফিসের ভেতরে থাকলে : ১. ভূমিকম্পের সময় যদি সম্ভব হয় মাথায় হেলমেট বা এ জাতীয় কিছু থাকলে মাথায় পরে নিন, অন্যদেরও পরতে বলুন এবং টেবিল, কিংবা বেঞ্চেরমতো শক্ত কিছুর নিচে আশ্রয় নিন। আশ্রয় নেওয়ার মতো টেবিল বা বেঞ্চ না থাকলে দুই হাত মাথার ওপরে রেখে ইটের গাঁথুনি দেওয়া পাকাঘর হলে ঘরের কোণে এবং কলাম ও বিমের তৈরি ভবন হলে কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন। সম্ভব হলে দ্রুত বৈদ্যুতিক ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ করে দিন। কোনো কিছু সঙ্গে নেওয়ার জন্য সময় নষ্ট করবেন না। কাচ, জানালা, কিংবা বাইরের দেয়ালের কাছ থেকে দূরে থাকুন।

২. আপনি যদি ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন, সম্ভব হলে নিরাপদ জাগায় চলে যান।

৩. যতক্ষণ পর্যন্ত ভূমিকম্প অনুভূতি হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বাইরে বের হওয়া নিরাপদ নয়। অধিকাংশ সময়ে আহত বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটে হুড়াহুড়ি করে ঘর বা অফিসে ঢোকা বা বের হওয়ার সময়।

৪. ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

ঘর বা অফিসের বাইরে থাকলে : ১. যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। নিরাপদ মনে না হলে নিরাপদ জাগায় চলে যান। ২. বড় বড় বিল্ডিং, বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা বড় গাছ থেকে দূরে সরে যান।

গাড়ির ভেতর থাকলে : ১. গাড়ি দ্রুত বন্ধ করে নিরাপদ জাগায় গাড়ি পার্ক করুন এবং গাড়ির মধ্যেই অবস্থান করুন। রাত হলে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখুন। ২. গাড়ি বড় বিল্ডিং, গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছে পার্ক করবেন না। ৩. গাড়িতে এচঝ থাকলে আপানর অবস্থান জেনে নিন। অনিরাপদ মনে হলে জরুরি সাহায্যের জন্য জরুরি নম্বরে যোগাযোগ করুন। ৪. ভূমিকম্পের সময় কোনো সেতুর ওপর দিয়ে অথবা ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করবেন না।

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকলে : ১. আলোর জন্য ম্যাচ বা গ্যাসলাইট জ্বালাবেন না। ২. আপনার মুখমণ্ডল ও মাথা পরনের জামা দিয়ে ঢেকে ফেলুন। ৩. আপনার সামনে বা পেছনে কিছু সরানোর চেষ্টা করবেন না, যা কি না বিপদ ডেকে আনতে পারে। ৪. শেষ সুযোগ হিসেবে চিৎকার করতে পারেন। মনে রাখবেন বেশি চিৎকার করলে ধ্বংসস্তূপের ধুলাবালি মুখে যেতে পারে, যা কি না নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে।

তথ্যসূত্র : সংগৃহীত

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close