reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৬ এপ্রিল, ২০২১

কালের সাক্ষী

ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি

একসময়ের ধানমন্ডি-৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি। যার পরিবর্তিত বর্তমান ঠিকানা ১০ নম্বর বাড়ি, রোড নম্বর-১১, ধানমন্ডি-ঢাকা। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ নামে। ১৯৬১ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে এখানেই থাকতেন। এ বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপ। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার ছয় বছর পর তার বড় সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেও তাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে তিনি হাউস বিল্ডিংয়ের ঋণ শোধ করে বাড়িটি বুঝে পান। এরপর বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট থেকে বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।

দখল হয়ে যায় বাড়িটি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই বাড়িটি সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যকেই এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরলেও সেদিন তাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যসের জন্য দোয়া ও মিলাদ পড়েন তিনি। এর কিছুদিন পর হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটি নিলামে ওঠানো হয়। তৎকালীন প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় নিলামে চড়ানো হয় বাড়িটি। সে টাকা পরিশোধ করে বাড়ি বুঝে পান শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের জুন মাসের ১০ তারিখে বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ট্রাস্টিই বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়।

দেয়ালে রক্তের ছাপ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী এবং তার স্বামী প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাগ্নি সেলিমা খাতুন বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে যখন বাড়িটি বুঝে পান তখনো এ বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছিল রক্তের ছাপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরম মমতায় নিজে এবং তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বাড়িটি পরিষ্কার করেন।

সেলিমা খাতুন জানান, রাজধানীতে নিজেদের থাকার কোনো জায়গা না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোনের ইচ্ছানুযায়ী এ বাড়ি জাদুঘর করার সিদ্ধান্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাড়িটিকে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ঘাতকচক্র এই বাড়িটি সিল করে রাখে এবং বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।

১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এসব আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়ি।

এখান থেকেই ট্রাঙ্ককলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন কাক্সিক্ষত স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখন্ড ও লাল সবুজের পতাকা। এই বাড়িতেই শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের এই বাড়ি জাদুঘরে রূপান্তরিত করার কাজে যারা শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। প্রয়াত কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক বেবী মওদুদ, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, ফটো সাংবাদিক পাভেল রহমান প্রমুখ নানা সময়ে জাদুঘর সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত ছিলেন।

ওই সময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শেখ হাসিনা এখানে-ওখানে থাকছিলেন। তাকে কেউ বাসাভাড়া দিচ্ছিলেন না। এমনকি অনেক নিকট আত্মীয়ও তাকে থাকতে দিতে চাননি। একপর্যায়ে তার স্বামী মহাখালীতে সরকারি কোয়ার্টার পান। এরপরই তিনি থিতু হন। তবে তার রাজনৈতিক কর্মকা- ধানমন্ডি-৩২ থেকেই পরিচালিত হতো। প্রায় প্রতিদিন সকালে পারিবারিক কাজকর্ম সেরে তিনি এখানে আসতেন। বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে ফেরত যেতেন। এমনই এক দিন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি হয়ে পড়েন গৃহবন্দি। এরপর থেকেই তিনি বাড়িটিকে কীভাবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় সে ভাবনা ভাবতে থাকেন। তার ধারাবাহিকতায় এটি আজ জাদুঘর।

সে সময় পরিস্থিতি বৈরী থাকায় এর কাজ এগোয় খুব ধীরগতিতে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে এ নিয়ে দুই বোন আলাপ-আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। আর এ ট্রাস্টের মাধ্যমেই বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।

যেভাবে শুরু হয় বাড়িটি

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার সময় বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সপরিবারে সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিস দেওয়া হয়। অবশেষে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় মাসিক ২০০ টাকায় বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে পুলিশ কর্মকর্তার মালিকাধীন বাড়ি ভাড়া নেন। সরকারি এজেন্সির হুমকি-ধমকির মুখে এ বাড়িটিও ছাড়তে বাধ্য হন তারা। পরে কবি সুফিয়া কামালের প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় ওঠেন।

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের বর্ণিত তথ্য ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালীন তার একান্ত সচিব নূরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমন্ডি এলাকার জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদনপত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ছয় হাজার টাকায় ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে প্রথমে এখানে দুই কক্ষের একতলা বাড়ি ও পরে দোতলা করা হয়।

১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্মাণাধীন এই বাড়িতে ওঠেন। তখন একতলা বাড়িটিতে মাত্র দুটি শয়নকক্ষ ছিল, যার একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। ১৯৬৬ সালে দোতলার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিচতলার এই কক্ষেই বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। দোতলায় বসবাস শুরু হলে এই কক্ষটি তিনি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। উত্তর পাশের লাগোয়া কক্ষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থাকতেন। এই কক্ষেরই একপাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ, যা ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সফল নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত এই বাড়ি থেকেই দেওয়া হতো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যে দিকনির্দেশনা দিতেন সেই মোতাবেক দেশ পরিচালিত হতো।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। এ খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু এই বাড়ির নিচতলায় তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তার স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই বাড়ি থেকেই ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিট তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির পিতাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করে রাখে। বাংলাদেশ বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। অন্যদিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে মুজিব পরিবারকে বন্দি করে রাখা হয়।

সরকারি বাড়িতে না উঠে নিজের বাড়িতে থাকছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়েছিল এই বাড়িটি। তাই তিনি নিজ বাড়িতে উঠতে পারেননি। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। বাড়ির মেরামত কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার পরিবার নিয়ে সরকারি বাসায় না উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।

কিন্তু এই বাড়ি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোররাতে জাতির জনকের রক্তে ভেসে যায়। একে একে ঘাতকরা হত্যা করে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী), শেখ কামাল (বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র), শেখ জামাল (বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র), শেখ রাসেল (বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র), শেখ আবু নাসের (বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই), সুলতানা কামাল খুকু (শেখ কামালের স্ত্রী), পারভীন জামাল রোজী (শেখ জামালের স্ত্রী)। বঙ্গবন্ধু পরিবারের মোট আটজনকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাকা-ের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট মূল ভবনের উত্তরে এর সম্প্রসারিত ভবন উদ্বোধন করা হয়। এই ষষ্ঠতলা ভবনে ২৬টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর তথ্য ও সচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close