ড. মিল্টন বিশ্বাস
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে আমাদের প্রত্যয়
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনন্য মুহূর্ত এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একাধিক ভাষণে স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থ প্রাণ উৎসর্গকারীদের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উল্লেখ করেছেন। আসলে ৫০ বছর ধরে এই অত্যন্ত সংবেদনশীল দিনটি বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করে চলেছে। ২০২১ সালেও আমরা স্মরণ করছি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্মম মৃত্যুর করতলে প্রাণ দিয়ে আজও যারা দিশারি তাদের অবদানকে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে উদার মানবতাবাদী এবং সাম্যবাদী চিন্তা চেতনার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের স্পষ্টত প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এই দুই ধারার বুদ্ধিজীবীরা। তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, যা পরে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এজন্য বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী বাছাই করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায়, যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানোর পর নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী যারা ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবহারিক জীবনের চেয়ে ভাববাদী জগতের মানুষ হয়েও মানবকল্যাণে কাজ করেছেন তারাই যুগে যুগে নির্যাতিত হয়েছেন। নির্মম মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ শহীদদের নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। মানবসভ্যতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বুদ্ধিজীবীরা নিজের কালে জনপ্রিয় ছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি আস্থার চেয়ে বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য সাধারণ মানুষের বেশি ছিল। এজন্য বুদ্ধিজীবীদের বিপক্ষে সব সময়ই এক শ্রেণির মানুষের আক্রোশ রাজনীতির ময়দানে উত্তাপ বিলিয়েছে।
এর কারণ সম্ভবত বুদ্ধিজীবীরা সমকালীন রাজনীতিকে নিজস্ব চিন্তা ধারায় প্রভাবান্বিত করেছিলেন; এমনকি স্রোতের বিপরীত ধারা তৈরি করেছেন। কখনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখনী দিয়ে নাড়া দিয়েছেন কোনো কোনো শিক্ষক। তাদের আবেদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অধিকারের প্রশ্নে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ শিক্ষার্থী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন জীবন পরিচালক; সুখণ্ডদুঃখের সাথি। হত্যার নির্মমতা তুচ্ছ হয়ে গেছে তাদের চিন্তাধারা ও সৃষ্টিশীলতার কাছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ঘোষিত হোক সর্বত্র- এই প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও গবেষক
অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"