০৮ মার্চ, ২০২১

সালমা খাতুন ও রেহানা পারভীনের মুখোমুখি

ক্রীড়াঙ্গনেও স্বমহিমায় নারী

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি দারুণ টান সালমা খাতুনের। বোলিং-ব্যাটিং দুটোতেই তুখোড়। অথচ ক্রিকেটার হওয়ার কল্পনাও করেননি কোনো দিন। খুলনার একটি গ্রাম থেকে উঠে এসে পাঁচতারকা হোটেলে থাকবেন, এমন চিন্তাও মাথায় আসেনি কখনো। সেই সালমা এখন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের কাণ্ডারি। শুধুই কি দেশে? ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বসেরা নারী অলরাউন্ডার তিনি। চার ভাই-বোনের মধ্যে সালমা সবার ছোট। খুলনায় নানার বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই থাকতেন। ছেলেরা ক্রিকেট খেলার সময় সালমাকে দলে নিত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথমবার ব্যাট হাতে তুলে নিলেন। এলাকাভিত্তিক খেলার সব মেডেল, ট্রফি সালমাই পেতেন। ১১ জনের দলে সালমাই ছিলেন একমাত্র নারী। তার কারণেই দল জিত। ভরদুপুরে জানালার কাছে এসে যখন তার খেলার সাথিরা ডাকতেন, মাঝেমধ্যে মা বকুনি দিতেন। পরে মেয়ের ইচ্ছা-স্বপ্নকে তার মা-বাবা গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০০২ সালে সালমার বাবা মারা যান। এর ৫ বছর পর জাতীয় দলে ডাক পান। তার সাফল্য দেখে যেতে পারেননি বাবা। সালমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা এটাই। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হন সালমা। ২০১৩ সালে আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে তিনি খেলেন ক্যারিয়ারসেরা ৭৫ রানের ইনিংস। ক্রিকেট বিশ্ব তাকে অন্যতম সেরা নারী ক্রিকেটার মনে করে। বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে প্রতিদিনের সংবাদের মুখোমুখি হয়েছেন দলনেত্রী সালমা খাতুন। তার জীবনের উত্থানের গল্প শোনানোর পাশাপাশি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বার্তাও দিয়েছেন তিনি।

নারীদের জন্য আপনার বার্তা কী? শুরুতেই সবাইকে নারী দিবসের শুভ কামনা। নারীরা নিজ নিজ জায়গায় ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক। সেই সঙ্গে প্রত্যেক নারী তার জায়গা থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক। আজকের দিনে নারীদের জন্য আমার বার্তা হচ্ছে তারা যেন আপন মহিমায় ছুটে চলে। তার প্রাপ্য সম্মান ও দাবি যেন সে আদায় করে নেয়। নারীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক, নির্যাতন রুখে দিক, সামনের সব বাধা ডিঙিয়ে যাক।

ক্রীড়াঙ্গনে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কতটুকু এগিয়েছে? শুরুতে আমরা অতটা সুযোগ-সুবিধা পেতাম না। এখন মনে হচ্ছে আমরা ছেলেদের মতোই এগিয়ে যাচ্ছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রীও আমাদের সঙ্গে থাকবেন, আমাদের সমর্থন জোগাবেন।

খেলতে গিয়ে নারীদের কী কী বাধার সম্মুখীন হতে হয়? আমরা যে সময়ে খেলতে আসি, তখন পরিবার থেকে তেমন সাপোর্ট পেতাম না। নিজের এলাকায়ও সাপোর্ট পাইনি। এখন যেহেতু আমরা ক্রিকেটের একটা পর্যায়ে চলে এসেছি, তাই সাপোর্টও পাচ্ছি। ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি দরকার এই সাপোর্ট। সেটি পরিবার থেকে বেশি জরুরি। পরিবার থেকে যদি আমরা সাপোর্ট পাই, তাহলে একসময় এলাকা থেকেও পাব। আমি চাই একজন নারী যখন ক্রীড়াঙ্গনে আসে, তখন যেন তার পরিবার ও সমাজ তাকে সাপোর্ট দেয়। তাহলেই নারীরা ক্রীড়াঙ্গনে আরো ভালো জায়গায় যেতে পারবে।

ক্রিকেটে আসতে চায় এমন নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? ক্রীড়াঙ্গনে অনেকেই আসতে চায়। তবে সেটি সহজ নয়। অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনার সন্তানকে যদি ক্রীড়াঙ্গনে দিতে চান, তাহলে তাকে প্রচুর সাপোর্ট দেন। আপনার আশপাশের লোকজন কী বলছে, এসব মাথায় নেওয়ার দরকার নেই।

আগামীতে নারীদের কোন স্থানে দেখতে চান? সব ক্ষেত্রেই নারীরা ভালো করছে। আমার চাওয়া নারীরা তার নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের যেন সবাই সম্মান করে, সেভাবেই এগিয়ে যাক।

দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুভূতি জানতে চাই। এটা অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার। ভাষায় বোঝানো কঠিন। এর সবই সম্ভব হয়েছে আমার কোচ এহসান স্যারের জন্য। আজকে এত দূর আসতে পেরেছি তার জন্যই। তিনি সব সময় বলতেন, কথা অনেক বলা যায়। কিন্তু মাঠে কাজ করাটাই আসল। তিনি আমাকে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

অধিনায়কত্বের চাপ সামলানো কতটা চ্যালেঞ্জিং? আমি সতীর্থদের সঙ্গে আচরণ ও সম্পর্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশেছি। ভালো-খারাপ সব দিনেই পাশে থেকেছি। দলের সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে। অধিনায়কত্বকে তাই চাপের বিষয় মনে হয় না।

বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার রেহানা পারভীন। ফুটবলের পাশাপাশি জাতীয় কাবাডি ও হ্যান্ডবল দলেও খেলেছেন। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পেয়েছেন ‘আনসার সেবা পদক’। ২০০৬ সালে জাতীয় প্রতিযোগিতায় অভিষেক হয় রেহানার। তখন প্রথম আন্তজেলা নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ঢাকা জেলার পক্ষে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার নৈপুণ্যে শিরোপা জেতে ঢাকা। এরপর বাংলাদেশ গেমসে কাবাডি ও হ্যান্ডবলেও চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। তিন খেলায়ই তার সমান দক্ষতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। তাই জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান সহজেই। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত দশম সাফ গেমসে বাংলাদেশ নারী জাতীয় কাবাডি দলে খেলার সুযোগ আসে। সেখানেও তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। সাফ গেমস থেকে দেশে ফিরেই ডাক পান এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্ব ফুটবলে। ভারতের আমন্ত্রণ পেয়ে বাফুফে একাদশের হয়ে দেশটির ৭টি রাজ্যে খেলেন তিনি। সেখানেও দুটি ম্যাচে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার ওঠে তার হাতে। ২০১২ সালে ভারতের পাটনায় অনুষ্ঠিত প্রথম নারী বিশ্বকাপ কাবাডিতে তিনি বাংলাদেশ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ফিফা এম এ এলিট রেফারিস কোর্স সম্পন্ন করেছেন অনেক আগে। এ ছাড়া কোচের স্বীকৃতি হিসেবে এএফসি ‘সি’ লাইসেন্স আছে তার। ভলিবল কোচেস কোর্স করাও বাদ রাখেননি। নিজ অর্থায়নে গড়ে তুলেছেন স্পোর্টস অ্যাকাডেমিও। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই তুখোড় ক্রীড়াবিদ প্রতিদিনের সংবাদের মুখোমুখি জানালেন তার লক্ষ্যের কথা।

ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা কতটা এগিয়েছে? আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের কথা বললে ছেলেদের তুলনায় নারীরাই এগিয়ে। সাফ গেমসের কথাই ভাবুন। মাহাফুজা শিলা সুইমিংয়ে দুটি স্বর্ণপদক পেয়েছে। মাবিয়া আক্তার ভারোত্তোলনে একটি স্বর্ণ পেয়েছে। শুধু খেলা কেন, শিক্ষাক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে।

নারীরা তার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে কি? এখনো পাচ্ছে না। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, গাড়িতে কয়েকটি সিট নারীদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সেগুলো পুরুষদের দখলে থাকে। ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের জন্য ৩০% কোটা থাকলেও সেটি আমরা পাই না। যারা এর প্রতিবাদ করবে, তাদের আজীবনের জন্য সরিয়ে দেওয়া হবে।

ক্রীড়াঙ্গনে আসার গল্প শুনতে চাই। ছোটবেলায় আমি ছিলাম ভীষণ দুরন্ত। খেলাধুলার পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেলও চালিয়েছি। প্রতিবেশীরা বিষয়টি সহজভাবে নিত না। তবে আমি এগুলো পাত্তা দিতাম না। স্কুল-কলেজে খেলাধুলায় বেশ নামডাক ছিল। তারপর আন্তজেলা নারী ফুটবল দিয়েই শুরু। প্রথম যখন ডাক এলো, তখন মা একটু আপত্তি জানিয়েছিলেন। আসলে তখনো তো এখনকার মতো মেয়েদের বাইরে খেলার ব্যাপারে স্বীকৃতি ছিল না।

নারীদের খেলায় আরো উন্নতি করা যায় কীভাবে? ভালোমতো যত্ন নিলে ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে আরো উন্নয়ন হবে। ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার জন্য যোগ্য ও দক্ষ লোকের প্রয়োজন রয়েছে। এ দিকটায় মনোযোগ দিতে হবে। মেধাবী সংগঠকের অভাবেও আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এগোতে পারছি না।

ফুটবলে আসার পথে নারীদের সবচেয়ে বড় বাধা কী? নারীরা সুযোগ-সুবিধা কম পায়। তাদের মূল্যায়ন করা হয় না বলেও আসতে চায় না। যদি তাদের পারিশ্রমিকটা ভালো হতো, তারা বাবা-মায়ের হাতে নিজেদের আয়ের বড় একটি অংশ তুলে দিতে পারত; তখন দেখতেন অভিভাবকরাও আগ্রহী হতেন তাদের মেয়েদের এখানে পাঠাতে।

কোচ হিসেবে কখনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন? অনেকে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই নানা কথা বলত। আমি পাত্তা দিতাম না। আর এই পাত্তা না দেওয়াটাই আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

আপনার স্পোর্টস অ্যাকাডেমি নিয়ে পরিকল্পনা কী? থানা ও জেলাপর্যায়ের ছেলেমেয়েরা এখানে প্র্যাকটিস করছে। নিজ অর্থায়নেই অ্যাকাডেমির কার্যক্রম চলছে। আসলে পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে কোনো কিছুতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পৃষ্ঠপোষক বা সহযোগিতা পেলে হতদরিদ্র এলাকা থেকে খেলোয়াড় তুলে আনা সম্ভব।

খেলোয়াড়ি জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আনসার সেবা পদক গ্রহণ। এটা সত্যি আমার জীবনের একটা বিশাল পাওয়া। আরেকবার দিল্লিতে খেলতে যাওয়ার সময় বিমানে উঠেই মায়ের কথা মনে পড়ায় কেঁদেছিলাম। কারণ, মা ছোটবেলায় প্রায়ই বলতেন, এত যে খেলা খেলা করিস, তুই কি দিল্লি যাবি? সত্যি যখন দিল্লি যাচ্ছি, তখন আর মা বেঁচে নেই। মা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন।

পিডিএসও/মীর হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নারী দিবস,ক্রীড়াঙ্গন,রেহানা পারভীন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close