আহসান হাবিব ইমরোজ
মোবাইল ফোনের ৫০ বছর ও আজকের তারুণ্য
১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল। এদিন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার ওয়ারলেস সেলুলার ডিভাইস তৈরি করেন। এটি আজকের মোবাইল ফোনের আদি সংস্করণ। ওই সময় আসল ফোনটি চার্জ হতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। এটি আড়াই পাউন্ড বা ১ কেজি ১৩০ গ্রাম ওজনের এবং ১০ ইঞ্চি লম্বা ছিল। ৫০ বছর পর ৯৩ বছর বয়েসি ওই প্রকৌশলীর এখন সুর পাল্টেছে। তিনি বলছেন যে, মানুষকে ‘জীবন লাভ’ করতে হবে এবং তাদের ডিভাইসগুলি এত বেশি ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
গত বছরের ২৮ জুন বিবিসি ব্রেকফাস্টের সাথে চ্যাট করার সময়, শিকাগোর এই উদ্ভাবক বলেছিলেন যে, তিনি তার সময়ের 'পাঁচ শতাংশ' কম তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। যারা প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটি ব্যবহার করে, তাদের প্রতি তিনি বলেছিলেন, যেন তাদের ফোন তারা রেখে দেয় এবং একটু ভালোভাবে বাঁচার চেষ্টা করেন।
ডিভাইস আসক্তি : নিজেকে সুরক্ষার উপায় গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ৭৫ বছর আগে এক বিজ্ঞানী-বন্ধুকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, আমি ভয় করি সেই দিনটি, যেদিন প্রযুক্তি আমাদের মানবিক সুন্দরতম সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যাবে। পৃথিবীময় তৈরি হবে বোকা প্রজন্ম।
সেদিন কি সত্যিই এসে গেছে? আজ মোটা দাগে আেমরা দেখছি আমাদের যুবক-তরুণরা- দৈহিকভাবে ওরা স্থবির ও মুটিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সৃজনশীলতা ও ধারণক্ষমতায় ঘাটতি হচ্ছে। মানবিকক্ষেত্রে অসামাজিক ও স্বার্থপর হচ্ছে। নৈতিকক্ষেত্রে আল্লাহভীতি কমে গিয়ে নানান অপরাধে জরানোর শঙ্কা বাড়ছে।
যে ডিভাইস নিয়ে এত্তোকথা সেটি তরুণদের ব্যবহারের কী পলিসি হওয়া উচিত? শুধু তরুণদের বা তাদের অভিভাবকদের দোষ দিয়ে বা কী লাভ! ৪র্থ শ্রেণির বাংলা বোর্ড বইয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে একটি প্রবন্ধ দেয়া হয়েছে। যা শিশুমনস্তত্ত্ব এবং মডার্ন শিক্ষাবিজ্ঞান (Pedagogy) সম্পর্কে ধারণার অভাব থেকে প্রণীত। অথচ, ফ্রান্সে ১৫ বয়স বছর বয়স পর্যন্ত এবং ইংল্যান্ডে ৯৮% প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ।
পিসার The Programme for International Student Assessment (PISA) দৃষ্টিতে চায়নার মাধ্যমিক শিক্ষার মান পৃথিবীতে শীর্ষে। অথচ সেখানে স্কুলে মোবাইল নিষিদ্ধ। মুসলিম বিশ্বের শিক্ষায় শীর্ষে থাকা একটি দেশ- ইরানে এজন্যে ছাত্রকে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত সাসপেন্ড করা হয়ে থাকে। কাকে দোষরোপ করবো? আমাদের সন্তানের দায় আমাদের। সুতরাং দায়িত্বও আমাদেরকেই নিতে হবে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে আমাদের সিরিয়াস হতে হবে।
স্মার্টফোন : তরুণ প্রজন্মের ভবিষৎ শিশু-কিশোর-তরুণদের ওপর স্মার্টফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেসবুকের সাবেক প্রেসিডেন্ট শান পার্কার ক’বছর আগে বলেছিলেন, কেবল মাত্র গডই জানেন যে, এটি (স্মার্টফোন) আমাদের সন্তানদের মস্তিস্কে কী করছে।’ কিন্তু এখন তো ঘরে ঘরে আমরা সবাই কমবেশি টের পাচ্ছি।
তোতাপাখির মতো অধো আধো কথা বলে, প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে সারা ঘর মাতিয়ে রাখা একরত্তি মেয়েটি আজ একদম চুপ। নানান রঙের উদ্ভাবনায় স্বজন-বন্ধুদের চমকে দেয়া তরুণ ছেলেটি আজ কেমন রোবট হয়ে গেছে। কমান্ড ছাড়া কোনো কাজ করে না। গ্রাম থেকে নানা-দাদু এলেও ওদের ভেতর আর উচ্ছ্বাসের বান জাগে না। একই ভুল পাঁচবার করছে। কিন্তু চেঞ্জ হচ্ছে না। দুই দুগুণে কত- জিজ্ঞেস করলেও অটো হাত চলে যায় গণনাযন্ত্রের দিকে।
আজকে কী বার- বললেও মাথা চুলকায়। সহজেই হার মানার স্বভাব। মুটিয়ে যাওয়া, কম ঘুমানো আর স্বার্থপরতা তো আছেই। এর কারণ কী? কারণ তাদের হাতে এসেছে অভিভাবকেদের স্মার্টফোন কিংবা অনেক অবুঝ অভিভাবক ছেলে ভুলানোর জন্য দামী খেলনার মতো এটি তুলে দিয়েছেন একবারে শিশু-কিশোরদের হাতে।
এ জটিল সমস্যার জাল থেকে জাতিকে রক্ষার উপায় কী? টেক জায়ান্টদের কী অবস্থা? তারা কী করছেন? স্মার্টফোনের শ্রেষ্ঠ রূপকার স্টিভ জবস তার বাচ্চাদের আইপ্যাড দিয়ে খেলতে দেননি, যা তিনি নিজেই তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। জাস্টিন সুলিভান নামক এক সাংবাদিক বিল গেটস, স্টিভ জবস, সুন্দর পিচাই এবং অন্যান্য টেক পাওয়ার প্লেয়ারদের সাথে তার নেয়া সাক্ষাত্কারগুলি প্রকাশ করে যে সিলিকন ভ্যালির পিতামাতারা তাদের সন্তানদের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে খুবই কঠোর৷
কেউ হয়তো বলতে পারেন, ভাই আপনার তো পকেটের সমস্যা। তাই এত দার্শনিক কথা বলছেন। স্মার্টফোনে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও আছে। তাদের বলব, দয়া করে মাফ করবেন এবং শুনুন। এই বিশ্বে বিশ ও একুশ শতকে ২১ বছর যিনি সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ ছিলেন সেই বিলগেটস; যিনি ১৪ বছর না হওয়া পর্যন্ত তার সন্তানদের স্মার্টফোন দেননি। সুতরাং কাকে দোষরোপ করবো?
আমি ২০০০ সাল হতে এটি ব্যবহার করছি। তখন ওয়ারলেসের মতো এ্যান্টেনা ছিল। মিনিটে ১৫ টাকায় কথা বলতাম। বলা ভালো, নিজের মুরোদে নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের পিএম হিসেবে এই সুযোগ পেয়েছিলাম। ২৪ বছরের সেই অভিজ্ঞতায় কিছু কথা বলতে চাই। জীবনের প্রয়োজনেই যন্ত্রের জন্ম। কিন্তু যান্ত্রিক জীবন কারো কাম্য নয়। যা নিয়ে আসতে পারে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। আবার যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার বুদ্ধি, সমৃদ্ধি ও সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়।
যন্ত্রেরই এক নবসৃষ্টি ভার্চুয়াল জগৎ। ভারসাম্যপূর্ণভাবে এটি ব্যবহার করতে পারলে ভবিষৎ সম্ভাবনার। আর এর দাসে পরিণত হলে জীবন হতে পারে এক নরক যন্ত্রণার।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে ৭টি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
১. সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার যেন অভ্যাসগত না হয় বরং একান্ত প্রয়োজনে হয়।
২. এটি ব্যবহারে আমাদের বাস্তব জীবনের স্বজন এবং বন্ধুদের উপরই শুধু ফোকাস করবো।
৩. প্রতিদিন স্ক্রল করার সময় সীমিত করবো।
৪. এমন ব্যক্তি এবং পৃষ্ঠাগুলি অনুসরণ করবো, যা আমার দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য কল্যাণকর।
৫. ঘুমানোর আগে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবো।
৬. নামাজ, কুরআন তেলাওয়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় মোবাইল ফোন থেকে বিমুক্ত থাকা।
৭. বিরতি নেয়া! ঘুমের সময় বন্ধ এবং বাহিরে থাকা অবস্থায় ব্যাগের ভেতর মোবাইল রাখার চেষ্টা করা।
এছাড়া সোসাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য দিনের শুরুতে এবং মাঝে মাঝে আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ এবং সূরা আসর পড়ে নেয়া। ভার্চুয়াল এবং রিয়েল লাইফের ভারসাম্য আজকের তারুণ্যের এক বড় চ্যালেঞ্জ। কবির কথাকে কিঞ্চিৎ বদলে বলা যায়- ‘এখন যৌবন যার বিশ্ব গড়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। লেখক : শিশু সাহিত্যিক ও গবেষক।পিডিএস/এইচএস