আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
শরৎ শুভ্রতায় পবিত্র হোক মুমিন হৃদয়
ষড়ঋতুর রূপময় দেশ- বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন রূপে সজ্জিত রূপসী বাংলার এই রূপ সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না পৃথিবীর অন্য কোথাও। ষড়ঋতুর মতো নেয়ামত আল্লাহতায়ালা শুধুমাত্র আমাদেরকেই দিয়েছেন। তাই তো কবি বলেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি/সকল দেশের রাণি সে যে আমার জন্মভূমি...।’
আর এই অনন্য নেয়ামত বা ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হচ্ছে শরৎকাল। রিমঝিম বর্ষার পরেই শোভাবর্ধনকারী শরতের আগমন। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতিতে লাগে শুভ্রতার ছোঁয়া। শরতের প্রত্যুষে শিশিরসিক্ত সবুজ পাতায় যখন সূর্যের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ে, তখন পাল্টে যায় প্রকৃতির চেনা রূপ। গ্রামের দুর্বাভেজা মেঠো পথে যখন পা পড়ে, তখন মনে হয় এ যেন মুক্তা খচিত সবুজ গালিচা। শিশিরভেজা অজস্র শেফালির সুগন্ধে বিমোহিত করা চারদিক, দুপুরে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা আর ঝিরঝিরে বাতাসে ধানক্ষেতের সবুজ ঢেউ, আনমনা করে তোলে উদাসী চিত্তকে। নদী ও খাল, কিম্বা বিলের ধারে শুভ্র কাশফুলের হাতছানি উপেক্ষা করে সাধ্য কার? শরৎ যেন সাদা কাশফুলের বিমুগ্ধ শুভ্রতায় মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের নিমন্ত্রণ। কবির ভাষায় ‘আমি অবাক নয়নে চাহিয়া যে রই,/বাতাসে হেলে দুলে উঠা ওই/কাশফুলের পানে, মুগ্ধ প্রভু আমি মুগ্ধ/এই সৃষ্টিরাজির শানে।’
শরৎ মানেই যেন সুদূর নীলিমায় ধূমল, কোমল গৈরিক আর শুভ্র মেঘের অবাধ বিচরণ। শুধু মেঘ আর মেঘ। আকাশ যেন এখন মেঘেদের মিলনমেলা। পালতোলা নৌকার মতো নীল আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো এ সাদা মেঘমালা, হৃদয়ে এনে দেয় প্রশান্তির আবেশ। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল, এ মেঘও কিন্তু আল্লাহতায়ালার এক অপার নেয়ামত। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, তারপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন, অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকেই ঝড়ে পড়ে বারিধারা...’- (সুরা আন-নূর, আয়াত : ৪৩)।
শরতের সৌন্দর্য শুধু মেঘমকালা দিয়েই শেষ নয়। স্নিগ্ধ বাতাসে ভেসে আসা শিউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, বেলী, জারুল, রঙ্গন, টগর, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, নয়নতারা, সন্ধ্যামণি, জয়ন্ত্রীসহ নাম না জানা আরও অসংখ্য ফুলের সৌরভ হৃদয়কে করে মুগ্ধ বিহ্বল। আর এ রূপ সৌন্দর্য সে তো কেবল মহিমান্বিত আল্লাহরই অনুদান। তিনিই শরৎকে এমন সৌন্দর্যময় করে সাজিয়েছেন। কারণ তিনি নিজে যেমন সুন্দর, তেমিন ভালোও বাসেন সৌন্দর্যকে। সে জন্যই তিনি শরৎকে করেছেন ঋতুর রাণি। কেউ কেউ আবার শরতকে আদর করে বলেন রূপের রাণি। এর কারণ, শরতের রূপমাধুরী যে একেক সময় একেক রকমের। এই যেমন ভরা নদীর স্বচ্ছ জলে ঝকঝকে রোদের ঝিলিক শরতের একরকম সৌন্দর্য। আবার সন্ধ্যায় অস্তগামী সূর্যের রঙিন প্রভায় আরেক রকমের সৌন্দর্য। এক কথায় শরৎ হচ্ছে সৌন্দর্যের আধার। এমন অপূর্ব সৌন্দর্যের সঙ্গে মিতালি করেছে আরেক যে সৌন্দর্য, তার নাম আকাশ। মাথার ওপরের এই বিস্তীর্ণ আকাশ যেন এক বিশাল নীল সমুদ্র। এই বিশাল আকাশের দিকে তাকালে জ্ঞানীদের মনের গভিরে প্রথমেই যে প্রশ্ন উঁকি দেয়, তা হচ্ছে ‘কে সেই স্রষ্টা? যিনি এক খুঁিটহীন বিশাল আকাশ সৃজন করেছেন।’ আকাশে দু’চোখ মেলে ভাবুক যখন এমন ভাবনায় অস্থির, ঠিক তখনই মনের মিনারায় অদৃশ্য ঘোষক ঘোষণা করে, ‘এই সুনিপুন সুনীল আকাশ সে তো মহান আল্লাহরই সৃষ্টি।’
পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘তোমরা কি লক্ষ্য কর না? আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন সপ্তস্তরে বিন্যস্ত আকাশমন্ডলী এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোকরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে’- (সুরা নূহ, আয়াত ১৫-১৬)। শরতের রূপ বর্ণনা যেন শেষ করার মতো নয়। শরতের চাঁদনী রাতের সেই স্নিগ্ধতা না ভাষায় ব্যক্ত করা যায়, আর না অক্ষরের রেখা টেনে তৃপ্তি পাওয়া যায়। শরতের চাঁদনী রাতের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে এক অন্যরকম মায়াবী পরিবেশ। চারদিকের সজিব গাছপালার উপর দিয়ে বয়ে যায় ঝিরিঝিরি বাতাস। ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় নীল জোনাকির দল। শুভ্র চাঁদোয়ায় আকাশ থেকে যেন নেমে আসে রূপকথার কল্প পরিরা। আর চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর পরশে দু’চোখ বন্ধ করলেই শোনা যায়, মনের মিনারে ধ্বনিতে হওয়া সেই শাশ্বতবাণী, ‘মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি আকাশে বুরুজ বানিয়েছেন এবং তাতে এক উজ্জ্বল প্রদীপ ও আলোকিত চাঁদ সৃষ্টি করেছেন সেই ব্যক্তির জন্য যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়’- (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৫-৬১)।
শরতের এই রূপসৌন্দর্য একদিকে যেমন মানুষের মনকে প্রকৃতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি মনের বাগিচায় রোপণ করে প্রভু প্রেমের সবুজ চারা। শরতের সাদা কাশফুলের মতোই কোমল আর শুভ্রতায় পবিত্র হয়ে ওঠে হৃদয়। শরৎকালকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদেরও আগ্রহের শেষ নেই। সে কারণেই শরৎ নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্যের জগতে কবি কালিদাস বিখ্যাত হয়ে আছেন তার ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্যই। কবি তার ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে শরৎ আগমনী বার্তায় লিখেছেন- ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমনীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালিধােেনর মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি, সেই নববধুর মতো শরৎকাল আসে।’
শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা ও গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শরৎ বন্দনায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদানও কম নয়। তিনি অসংখ্য গান ও কবিতায় শরৎবাংলার প্রকৃতির নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন। তিনি শরতের রূপ বর্ণনায় লিখেছেন ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে,/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে।’ শরতে নদী-নালা, খাল-বিলের পানিতে টুইটম্বুর হয়ে থাকে। যার ভেতরে ঝাক বেধে মনের আনন্দে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। পানির উপর ভেসে থাকে শুভ্র শাপলা, লাল পদ্ম। বিলের হাঁটু পানিতে চুপচাপ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাদা সাদা বক। সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু, পবিত্রতার প্রতীক। সে জন্যই হয়তো পুরো পৃথিবীর শিল্পী-সাহিত্যিকরা শরৎকে বিবেচনা করেছেন ‘শুভেচ্ছাবাহক ঋতু’ হিসেবে। কিন্তু মানুষের রুচি যে আজ অরুচিতে নেমেছে। তাদের নিমর্ম আচরণে তপ্তজলে ভরে উঠেছে শরতের দুই চোখ। শহরে এর চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। আগে যে নদীর তীর ছিল কাশফুলের অরণ্য, লোভি মানুষদের স্বার্থপরতায় সেখানে এখন তৈরি হচ্ছে মিল-কারখানা। সেসব মিল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালে শরতের শোভা এখন কালো কাফনে বন্দি। যদি এভাবে প্রকৃতির অনিষ্ট সাধনে মানুষ মেতে থাকে, তাহলে একদিন হয়তো শরতের সাদা কাশফুলের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না। হবে না কোনো কথাও। তখন শরৎকে খুঁজতে হলে উল্টাতে হবে বইয়ের পাতা।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার করণেও যে কোনো সময় নেমে আসতে পারে আসমানি গজব। যেমনটা হয়েছিল এই ক’দিন আগেও। সেই ভয়াবহ ‘করোনা’র কথা আমরা এত জলদি ভুলে গেলাম? করোনা কিন্তু আমাদেরই পাপের ফসল। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্যই জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটে’- (সুরা রুম, আয়াত : ৪১)। তাই, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্তে প্রকৃতির প্রতি উদার হই এবং শরতের এই বিমুগ্ধ রূপমাধুর্যে মোহিত হয়ে মহান আল্লাহর কুদরতি পায়ে অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে এই-ই প্রার্থনা করি-‘ প্রভু, সকলের মনের পুঞ্জীবনে জমাট বাঁধা কষ্টগুলো শরতের শুভ্রতায় ধুয়ে মুছে দিন। নির্মল আকাশের বুকজুড়ে রাশি রাশি সাদা মেধ মানব হৃদয়ে প্রভু প্রেমের যে বার্তা নিয়ে আসে, সেই শাশ্বত বানী জীবনে অটুট রাখুন চিরদিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
-খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া