ড. আবদুল আলীম তালুকদার

  ০৪ জুলাই, ২০২২

হজ বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে পবিত্র হজ অন্যতম। আভিধানিক অর্থে হজের অর্থ—ইচ্ছা বা অভিপ্রায় পোষণ করা, সংকল্প করা, সুদৃঢ় প্রত্যয় বা সিদ্ধান্ত নেওয়া, কোনো সম্মানিত স্থান দর্শনের সংকল্প করা। ‘আল-কামুসুল ফিক্হ’ গ্রন্থের ভাষায়, আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে, বিশেষ অবস্থায়, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্ধারিত নিয়মে, নির্দিষ্ট কতগুলো অনুষ্ঠান পালন করাকে হজ বলে। নির্দিষ্ট সময় বলতে ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। বিশেষ অবস্থা বলতে ইহরামের অবস্থাকে বোঝায়। নির্দিষ্ট স্থান বলতে কাবা শরিফ (সাফা-মারওয়াসহ) এবং তার আশপাশের মিনা, মুজদালিফা প্রভৃতি স্থানকে বোঝায়। নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান বলতে ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ, ওকুফ্ (অবস্থায়) ও কোরবানি হজের নির্ধারিত অনুষ্ঠানগুলোকে বোঝায়।

হজের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও দীর্ঘ পটভূমি এবং এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ্পাকের নির্দেশে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অন্যকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তারা সুদীর্ঘকাল পর আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হন। তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আদম সন্তানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর আরাফাতের মহামিলন প্রান্তরে সমবেত হয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন। তারা তাদের হৃদয়মন দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এভাবে সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাঈ, মিনায় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ এবং কোরবানির প্রেক্ষাপট, যা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা এবং তাদের পুণ্যবান সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর দ্বারা রচিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে। এভাবে হজরত আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত সর্বযুগের আল্লাহপ্রেমিক, আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ নবী-রাসুল, ওলি-আবদাল তথা আল্লাহর নেককার, সত্যপ্রাণ ও মকবুল বান্দাদের পরম ব্যাকুলতার সঙ্গে আল্লাহর ঘর তাওয়াফের মাধ্যমে হাজার হাজার বছরের আত্মনিবেদনের মাধ্যমে রচিত হয়েছে হজ ও জিয়ারাতের সুবিশাল প্রেক্ষাপট।

সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) বায়তুল্লাহ শরিফে হজ আদায় করেন। এরপর হজরত নুহ (আ.)-সহ অন্য নবী-রাসুল সবাই বায়তুল্লাহর জিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, বায়তুল্লাহ শরিফের পুনর্নির্মাণের কাজ সমাধা করার পর হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে এই পবিত্র গৃহের তাওয়াফ ও হজ করার জন্য বললেন। এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) উভয়েই তাওয়াফসহ হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমাধা করলেন। এরপর আল্লাহতায়ালা হুকুম করলেন, হে ইবরাহিম। তুমি সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও। এ মর্মে কোরআন মজিদের সুরা হজের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ তখন হজরত ইবরাহিম (আ.) একটি উঁচুস্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বামে পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে হজের ঘোষণা করে বললেন- ‘হে লোক সকল! বায়তুল্লাহ শরিফের হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দাও।’ এ আহ্বান শুনে পূর্বদিগন্ত থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত যাদের হজ নসিব হবে তারা সবাই লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (হাজির হে প্রভু! আমরা সবাই হাজির) বলেছে। কেউ সাড়া দিয়েছে একবার, আবার কেউ সাড়া দিয়েছে একাধিকবার। যারা একবার সাড়া দিয়েছে, তাদের একবার হজ নসিব হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পর যত নবী-রাসুল দুনিয়ায় এসেছেন তারা সবাই বায়তুল্লাহর জিয়ারত করেছেন ও হজব্রত পালন করেছেন।

জাহিলিয়াতের যুগেও লোকরা বায়তুল্লাহ শরিফের তাওয়াফ এবং জিয়ারত করত। কিন্তু তারা তা করত নিজেদের মনগড়া পন্থায়। নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার আলোকে জাহিলি বহু কর্ম তারা হজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, হজের মৌসুমে কুরাইশরা অন্য হাজিদের মতো আরাফায় না গিয়ে মুজদালিফায় অবস্থান করত। তারা বলত, আমরা স্থানীয় বাসিন্দা। আমাদের একটা বিশেষ স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য আছে। তাই অন্যদের মতো আমরা সেখানে যেতে পারি না। বস্তুত কালের বিবর্তনে হজ তখন তার আপন পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য হারিয়ে খেল-তামাশা এবং অশ্লীল চিত্তবিনোদনের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তখন তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কাবাগৃহের তাওয়াফ করত। ইসলাম জাহেলি যুগের এসব কুসংস্কার চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে নতুনভাবে হজের ফরজিয়াতের বিধান প্রবর্তন করে। এ মর্মে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা আলে ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরের হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।’

হজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক, বুদ্ধিমান ও সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এরপর যতবার হজ পালন করবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। নফল হজেও অনেক সওয়াব রয়েছে। তবে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত দেশের অধিবাসীর জীবনে একবার হজ পালন করাই শ্রেয়। হজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মাজিদের সুরা আলে ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ ফরমান, ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরিফে হজ পালন করা মানুষের ওপর অবশ্য কর্তব্য; যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’ যেসব লোক বায়তুল্লাহ শরিফ তথা পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফ পর্যন্ত যাতায়াতের দৈহিক ক্ষমতা রাখে এবং হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের আবশ্যকীয় ব্যয় বাদে যাতায়াতের খরচ বহন করতে সক্ষম তাদের ওপর হজ ফরজ।

কাবা আল্লাহর ঘর। পৃথিবীর প্রাচীনতম ইবাদত গৃহ। এটিই বিশ্ব মুসলিমদের কিবলাহ এবং মিলনকেন্দ্র। সুতরাং হজ হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন। বিশ্ব মুসলিম যে এক অখণ্ড উম্মত হজ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। গায়ের রং, মুখের ভাষা, আর জীবনপদ্ধতিতে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন এই সম্মেলনে তারা একাকার হয়ে যায়, তাদের সব পার্থক্য দূর হয়ে যায়। সবার পরনে ইহরামের সাদা কাপড়। সবার ধর্ম এক, উদ্দেশ্য এক, অন্তরে এক আল্লাহর ধ্যান, সবাই আল্লাহর বান্দা। সবাই ভাই ভাই। এসবই মুসলিমদের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের এক অপূর্ব পুলক শিহরণ জাগায়। তাদের মধ্যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে। সবার কণ্ঠে একই আওয়াজ ধ্বনিত হয়—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। ‘হাজির হে আল্লাহ্, আমরা তোমার দরবারে হাজির।’

হজ এমন একটি মিলনমেলা যা প্রত্যেক হাজিকে মুসলিম বিশ্বের লাখো মুসলিমের সঙ্গে পরিচয়ের বিরাট সুযোগ করে দেয়। একটি সফরে বহু সফরের সুফল পাওয়া যায়। ইসলামের ঐক্য, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও প্রাণচাঞ্চল্য বজায় রাখার ব্যাপারে হজের তাৎপর্য অপরিসীম। হজ মানুষের অতীত জীবনের গুনাহসমূহ ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়, মাফ করে দেয়। রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘পানি যেমন ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়, হজও তেমনি গুনাহগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়।’ (সহিহ বুখারি)। নবী করিম (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ আদায় করল, তারপর কোনো অশ্লীল কাজ করল না, পাপকাজ করল না, সে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরল।’ (বুখারি ও মুসলিম)

হজযাত্রায় যানবাহনে আরোহণ হাজিকে শবদেহ বহনের খাটিয়ায় সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরো সাদা মার্কিন কাপড় হজযাত্রীর মনে কাফনের কাপড়ের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। ইহরামের পর সব হাজির সমস্বরে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনির উচ্চারণ কিয়ামাতের দিন আহ্বানকারীর (আল্লাহ্) ডাকে সাড়া দেওয়ার সমতুল্য। সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাঈ করা হাসরের মাঠে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করার মতো। সেদিন যেমন সব মানুষ দিশাহারা হয়ে নবী-রাসুলদের কাছে সুপারিশের জন্য দৌড়াদৌড়ি করবে অনুরূপভাবে সম্মানিত হাজিরাও পুণ্যের আশায় সাফা-মারওয়ার মাঝামাঝি স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে থাকে। হজ মৌসুমে আরাফার মাঠে লাখো হজযাত্রীর অবস্থান হাসরের ময়দানের জনসমাগমের নমুনা বলে ধারণা করা হয়। প্রখর সূর্যালোকে সেদিন হজযাত্রীরা গলদঘর্ম হয়ে কঠিন এক ধৈর্যের পরীক্ষা দেন, যা করুণ দৃশ্যের অবতারণা করে।

হজের প্রতিটি আমলেই আমরা দেখতে পাই স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেমের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। ইহরাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। না আছে মাথায় টুপি, না শরীরে কোনো জামা-কাপড়, না আছে সুগন্ধিদ্রব্য এবং ফকিরের বেশে সদা চঞ্চল ও উদাসীন মনে সেলাইবিহীন শ্বেত-শুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত মুহরিমের সে কি এক অপূর্ব দৃশ্য। হজের মৌসুমে সমগ্র বিশ্বজাহান থেকে মুহাক্কিক উলামা এবং সুফি-সাধক ও ধর্মীয় সংস্কারকরা পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীতে জমায়েত হয়ে থাকেন। তাই এ সময় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সঠিক অবস্থা পর্যালোচনা করা, তাদের শিরক ও বিদায়াতের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা এবং মুসলিম বিশ্বে তালিম ও তাবলিগি মিশন প্রেরণের বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া যায়। হজ যেহেতু মুসলিম উম্মাহর এমন এক বিশ্ব সম্মিলন, যেখানে সব শ্রেণির মানুষই এসে সমবেত হয়। তাই এ সময় বিশ্বশান্তি স্থাপনে এবং জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে, লড়াই-সংগ্রামের পরিবর্তে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব গ্রহণ করা যায়।

হজ সম্মিলন মুসলিম উম্মাহর এক বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর শান্-শওকতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, বিক্ষিপ্ত শক্তিগুলো সুসংহত হয়, দিকে দিকে উম্মাহর সুখ্যাতি ও গৌরব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বহু কল্যাণ, উপকারিতা এবং ঐশী হিকমত হজের মধ্যে নিহিত রয়েছে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মহাসম্মিলন,হজ,বিশ্ব,মুসলিম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close