মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

  ১৭ মার্চ, ২০২২

মুক্তির রজনী লাইলাতুল বরাত

প্রতীকী ছবি

সমস্ত প্রশংসা মহান প্রতিপালকের, যিনি মানুষকে গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের জন্য কিছু সময়কে নির্ধারিত করেছেন; যেন তারা সে সময়ে তাঁকে প্রাণভরে স্মরণ করে তাদের পাপ মোচন করিয়ে প্রতিপালকের প্রিয় পাত্রে পরিণত হওয়ার সুযোগ পান। এই নির্দিষ্ট সময়গুলোর মধ্যে মহিমান্বিত, তাৎপর্যমন্ডিত, ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় রাত লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত।

শবে বরাত শাবান মাসের পঞ্চদশ রজনীতে পালিত হয়। রাসূল (সা)-এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন্ নিসফি মিন শাবান’ বা ১৫ শা’বানের রাত বলেছেন। ফার্সি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত বা রজনী। আর বারাআত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি, অব্যাহতি, পবিত্রতা ইত্যাদি। শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ হল- মুক্তি, নিষ্কৃতি ও অব্যাহতির রজনী।

এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তাআলা পাপী বান্দাদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত বলা হয়। যেহেতু এ মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী; তাই এ মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহ:। মানুষ যদি এ রাতে নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্বীয় চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত করে তবে আল্লাহ তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন।

ইরশাদ হচ্ছে- এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বণ্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ (সুরা দুখান : ১-৪)।

তাফসীরে জালালাইনে রয়েছে- নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হল লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন মাজীদ) ৭ম আসমান থেকে দুনিয়ায় (১ম আসমান) নাযিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী’। (তাফসীরে জালালাইন পৃষ্ঠা-৪১০)।

তাফসীরে বাগভীতে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবে ক্বদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন (তাফসীরে বাগভী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২২৮)।

‘শাবান’ মাসটি আরো একটি বিশেষ কারণে মর্যাদাবান। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; এ মাসে পূর্বের কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরীফের দিকে কিবলা নির্ধারিত হয়। ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমন্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং এমন কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেবো, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারাম (কাবা) এর দিকে চেহারা ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওই (কাবার) দিকেই মুখ ফিরাও।’ (সুরা বাকারা : ১৪৪)।

রাসূল (সা:)-এর প্রতি দুরূদ পাঠের নির্দেশনা সংবলিত আয়াতটি এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রাসূল (সা:)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন ও ফেরেশতারা রাসূল (সা:)-এর জন্য রহমত কামনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো’। (সুরা আহযাব : ৫৬)।

অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা রমজান মাসের জন্যে শাবান চাঁদের হিসাব রাখো’। রাসূল (সা:) রমজানের রোজা ব্যতীত শাবান মাসে অধিক রোজা রাখতেন, অন্য মাসে ততধিক রোজা রাখতেন না। রাসূল (সা:) শাবান মাসকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন।

আসমা ইবনে জায়েদ (রা:)-হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:)-ইরশাদ করেন- ‘শাবান আমার মাস, আর রমজান আল্লাহর মাস’।

আবূ মূসা আশয়ারী (রা:) রাসূল (সা:)-হতে বর্ণনা করেন। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘মধ্য শা’বানের রাতে আল্লাহ তাআলা রহমতের তাজাল্লী বর্ষণ করেন এবং তাঁর সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না’। (ইবনে মাজাহ)

আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত- রাসূল (সা:)-হতে তিনি বর্ণনা করেন, রাসূল (সা:) আয়েশা (রা:)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে তুমি কি জান? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:) শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের কী মর্যাদা রয়েছে? রাসূল (সা:) উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে এবং কতজন মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়।

অতঃপর আয়েশা (রা:) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:) “আল্লাহ রহমত ছাড়া কারো পক্ষে কি জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়? রাসূল (সা:) বললেন, আল্লাহর বিশেষ রহমত ও একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া কারো পক্ষে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথাটি রাসূল (সা:) তিনবার বললেন’। (মিশকাত, ফাজায়েলুল আওকাত)।

রাসূল (সা:) ১৫ শা’বানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদত করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। আলী (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- ‘শা’বানের ১৫তম রজনীতে তোমরা অধিক হারে আল্লাহ ইবাদত করো। অতঃপর দিনের বেলা রোজা পালন করো। সেদিন আল্লাহ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং আহ্বান করতে থাকেন, আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করবো; আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী, আমি তাকে রিজিক দান করবো; আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। এমন আরো বিষয়ে কেউ প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তা সবই তোমাদেরকে দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন’। (মিশকাত)।

আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক রাতে আমি রাসূল (সা:)-কে বিছানায় পেলাম না। এজন্য তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর আমি জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে নবীজীকে আকাশের দিকে মাথা মুবারক উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি এ ধারণা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) তোমার উপর অবিচার করেছেন? আয়েশা (রা:) বললেন, আমি এমন ধারণা করিনি, ভেবেছিলাম আপনি আপনার অন্য কোনো বিবির নিকট গমন করেছেন। তখন রাসূল (সা:) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পাক শা’বানের ১৫ তারিখ রাতে প্রথম আকাশে তাজাল্লী ফরমান- অতঃপর তিনি বনী কালব গোত্রের মেষের পশম সমূহের চেয়েও বেশি লোকের গুনাহ ক্ষমা করেন’। (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।

এজন্য এ রাতে নফল নামাজ, বেশি বেশি কাজা নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির-আজকার, দূরূদ ও তওবা-ইস্তিগফার করা উত্তম।

রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, ‘১৫ শাবান রাত জেগে ইবাদাত কর এবং পরদিন রোজা রাখ। এ রাতে আপনজন যারা তাদের কবর যিয়ারত কর’। তাই নিজ পিতামাতা ও আয়ত্তের ভিতরে আওলিয়ায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীনদের মাজার জিয়ারত করা অতি উত্তম। এতে ফয়েজ ও বরকত হাসিল হয়। তবে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সারা রাত ব্যয় করা বোকামি। কেননা, ‘রাসূল (সা:)-কে মা আয়েশা (রা:) শা’বানের ১৫ তারিখ রাতে জান্নাতুল বাকীতে মোনাজাতরত অবস্থায় পেয়েছেন’। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)

লাইলাতুল বরাতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন মুমিনের কর্তব্য। এ রাতে বোমা ফাটানো, তারাবাজি, আতশবাজি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, পোলাও-বিরানি ও হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসূল (সা:)-হতে শিখিয়ে যাওয়া এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা পীর মাশাইখগণ এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই হুবহু আমাদের অনুসরণ করতে হবে। এতে বাড়ানো-কমানোর কোনোই অবকাশ নেই। আল্লাহ আমাদের যথাযথভাবে লাইলাতুল বরাত পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তির রজনী,লাইলাতুল বরাত,শবে বরাত,ফেরেশতা,তাজাল্লী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close