মিথ্যা সাক্ষ্য ও এর পরিণতি
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে পৃথিবীতে বসবাস করে। এখানে সুশীল-কুশীল, উৎপীড়ক-উৎপীড়িত, সবল-দুর্বল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই থাকে। তাদের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন বিধিবিধান আরোপ করেছেন।
সেই বিধান বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত রাসূলে কারীম (সা)। যার ছোঁয়ায় পাল্টে গিয়েছিল বর্বর হিসেবে খ্যাত একটি সমাজ। মারামারি-কাটাকাটি ছিল যাদের নেশা, তারা হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের শান্তির দূত। কালান্তরে তাঁর উম্মাহ সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আজ বিজাতীয়দের হাসির খোরাক হিসেবে চিহ্নিত। মুসলিম সমাজে মিথ্যা বলা, অপবাদ দেয়া, পরনিন্দা করা, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা ছিল সম্পূর্ণ বর্জনীয়।
আজকের মুসলিম সমাজে এগুলো হয়েছে পালনীয় কাজ। তা দেখে ইবলিসও লজ্জায় মুখ ঢাকে। ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজ মুসলিমদের নিয়ে টিপ্পনি কাটে। এক মুসলিম যে অপর মুসলিমের ভাই, এ কথাটি মুসলিম সমাজে আজ বিলুপ্ত। শত্রুরা মুসলিমে মুসলিমে রেষারেষি সৃষ্টি করছে, অথচ আমরা বেমালুম তাদের থেকে প্রেরণা নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
কে কার বড় হব, কাকে আঘাত করতে পারলে আমার দল ভারী হবে; সেই চিন্তায় আমরা বিভোর। এরই লক্ষ্যে অহর্নিশ আমরা দোষারোপ, অভিযোগ আরোপ, কুৎসা রটনায় নিমজ্জিত রয়েছি। চাই তা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক। বাস্তবসম্মত হোক আর অবাস্তব হোক প্রতিপক্ষকে দামিয়ে রাখতে পারলেই যেন উদ্দেশ্য সফল। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের প্রশ্ন হলে তো আর কথাই নেই। এখানে নাকি সত্য-মিথ্যা বলতে কিছুই নেই।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের দেহে জিহবা ও দুই ঠোঁট সংযোজন করেছেন যাতে তারা কথা বলতে পারে। আর আল্লাহর দেওয়া মুখ ও ঠোঁট দিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত সত্য কথা বলবে, সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিবে যদিও তা তার নিজের, নিজ পিতা-মাতার এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয় (নিসা ৪/১৩৫)। অপরদিকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ইচ্ছাকৃত মিথ্যা কথা বলার ন্যায় বড় পাপ। মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে যেমন ব্যক্তির অধিকার হরণ করা হয়, সাথে সাথে সামাজিক বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়। এমনকি বিচার ব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দান ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
মিথ্যা সাক্ষ্য’র পরিচয়
সাক্ষ্যের আরবি ‘শাহাদাত’। এর অর্থ সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি।
ইমাম কুরতুবী (র.) মিথ্যা সাক্ষ্যের পরিচয়ে বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য এমন সাক্ষ্য, যা মানুষকে অন্যায় ও বাতিলের দিকে ধাবিত করে, চাই সেটা কোনো মানুষের ধ্বংস সাধন অথবা সম্পদ কেড়ে নেওয়া অথবা হারামকে হালাল করা অথবা হালালকে হারাম করার ক্ষেত্রে হৌক’। (দুররিল মুখতার : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬০)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার হুকুম
সকল বিদ্বান একমত যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে সাক্ষ্য গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষীর মতো। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্তুত তোমরা যা কিছু করছ আল্লাহ সে বিষয়ে খুব ভালোভাবেই জানেন। (সূরা বাক্বারাহ : ২৮৩)।
অনুরূপ সাক্ষীর জন্যও ওয়াজিব হলো সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হোক বা গরিব (সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চেয়ে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী। অতএব, ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল, অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ, আল্লাহ সবকিছু জানেন। (সূরা নিসা : ১৩৫)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কুফল
কবীরা গুনাহের অন্যতম হলো মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা.)-কে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
আবূ বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক স্থাপন করা ও পিতামাতার নাফরমানি করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। অতঃপর ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না। (বুখারী : ৫৯৭৬; মুসলিম : ৮৭)
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, মিথ্যা সাক্ষ্যদান যে একটি মহা পাপ তা তিনভাবে প্রমাণিত হয়। প্রথমত: এ কাজ করলে মহাপাপী হতে হয়, যা শিরকের মত মহাপাপের সঙ্গে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, সুতরাং তোমরা মূর্তিরূপ অপবিত্রতা বর্জন কর এবং মিথ্যা কথা (সাক্ষ্য) হতে দূরে থাক। (সুরা হজ : ৩০)
মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের শাস্তি
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কবিরা গোনাহ হলেও এর নির্দিষ্ট কোন শাস্তি ইসলামী শরিতে নেই। তাই এর শাস্তি হলো তা‘যীর তথা ভৎর্সনা করা। আর এটা অবস্থা অনুযায়ী বিচারক নির্ধারণ করবেন। তবে শাফেঈ, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাবের কোনো কোনো ইমাম বলেন, এর শাস্তি ১০টি বেত্রাঘাতের অধিক হবে না। আর ইমাম শাফেঈ (র.) বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার শাস্তি দশ চাবুকের অধিক নয়। (আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যা : ২৬/২৫৫)
নবী করীম (সা.) বলতেন, আল্লাহর নির্ধারিত হদসমূহের কোনো হদ ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে দশ বেত্রাঘাতের ঊর্ধ্বে দন্ড প্রয়োগ করা যাবে না। (বুখারী : ৬৮৪৮, ৬৮৪৯ ও ৬৮৫০; মুসলিম : ১৭০৮)
তবে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা সাক্ষীর কারণে যদি হদ্দ (শাস্তি) জারি হয় এবং পরে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রকাশিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কিসাস (ক্ষতিপূরণ) কার্যকর করা হবে।
এ ব্যাপারে ইমামদের অভিমত হলো, যে ব্যক্তি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা প্রমাণিত হবে তার নাম চারদিকে প্রচার করে দিতে হবে (কুরতুবী)। ওমর (রা.) বলেন, তার পিঠে চাবুক মারতে হবে, মাথা ন্যাড়া করে দিতে হবে, মুখ কালো করে দিতে হবে এবং দীর্ঘদিন অন্তরীণ রাখতে হবে। ওমর (রা.)-এর আদালতে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনি তাকে একদিন প্রকাশ্যে জনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং ঘোষণা করে দেন যে, এ ব্যক্তি হচ্ছে অমুকের ছেলে অমুক, এ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে, একে চিনে রাখো। তারপর তাকে কারাগারে বন্দী করেন। (বায়হাকী)
মিথ্যা সাক্ষ্য যেহেতু অন্যের হকের সাথে জড়িত সেহেতু যার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে অথবা মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে যার ক্ষতি করা হয়েছে তার নিকট থেকে ক্ষমা চাইতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেন, (আল্লাহ) ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই পাওনাদারের পাওনা আদায় করবেন। এমনকি শিংওয়ালা বকরী থেকে শিং বিহীন বকরীর প্রতিশোধও গ্রহণ করা হবে’।[28]
সাক্ষ্য গোপন করা
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যেমন অপরাধ তেমনি সাক্ষ্য গোপন রাখাও অপরাধ। যেহেতু উভয়টি নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে। যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে অন্যায়ভাবে ফেঁসে যায়, তখন সত্য সাক্ষ্য দিয়ে তাকে উদ্ধার করা নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং কেউ তা গোপন করলে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা আমল কর, আল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত। (সুরা বাক্বারাহ : ২৮৩)
সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার
বিচারক প্রকাশ্য বিষয় দেখেই বিচার করবেন, চাই সে সাক্ষ্য মিথ্যা হোক কিংবা সত্য। এ বিষয়ে উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি তো একজন মানুষ। আর তোমরা আমার কাছে বিবাদ মীমাংসার জন্য এসে থাক। তোমাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষ অপেক্ষা দলীল-প্রমাণ পেশ করায় বেশি পারদর্শী হতে পারে। ফলে আমি আমার শোনার কারণে যদি কাউকে তার অন্য ভাইয়ের হক দিয়ে দেই, তাহলে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কেননা, আমি তার জন্য জাহান্নামের একটা অংশই নির্ধারণ করে দিচ্ছি। (বুখারী : ৬৯৬৭ ও ৭১৬৯)
বিচারকের করণীয়
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’। ইবনু বুরায়দাহ (রা.) হতে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী, আর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে এবং তদনুযায়ী ফয়সালা করে। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামী এবং যে বিচারক অজ্ঞতাপ্রসূত রায় দেয় সেও জাহান্নামী।
তাই মুসলিম সমাজের উচিত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। অন্তত এটুকু কাজ করলেও পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেকটা শান্তি নেমে আসবে। আল্লাহ আমাদেরকে সত্য বলার ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন-আমীন!