কোণঠাসা জাতীয় পার্টি
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম থেকেই সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও বিলুপ্ত হওয়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকটা কোণঠাসা দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে দলটি। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংলাপে এখনো আমন্ত্রণ পায়নি জাপা।
দলটির একজন শীর্ষনেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার নিকটবর্তী দল হিসেবে পরিচিত। দলটি ক্ষমতাসীন বড় দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে বলে নানা সময়ে সমালোচিত হয়েছে। জাতীয় পার্টির ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিলেও সুযোগ বুঝে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছে, যে কারণে তারা এখন কোণঠাসা। বিষয়টি বুঝে এ পরিস্থিতিতে দলের করণীয় ঠিক করতে গত সোমবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে সারা দেশে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন জি এম কাদের। জাপার কয়েকজন শীর্ষনেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। গতকালও দলটি মামলার প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।
জাপার এক নেতা বলেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘একটি চক্র জাতীয় পার্টিকে ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি, আমাদের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে অংশ নিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়ে জেল খেটেছেন। ওই আন্দোলনে হত্যা মামলায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে।’ জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছি। আমাদের চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রকাশ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। এখন আমাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। নেতাকর্মীদের সারা দেশে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছি।’
ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান নেয়। তবে ভোটারবিহীন ও একতরফা হিসেবে আখ্যা পাওয়া দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলটি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে ‘আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী’ হিসেবে অভিহিত হয়। ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর অভিযোগ বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। ২০২৪ সালের নির্বাচন যখন সব দল বর্জন করে তখন জাতীয় পার্টিও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এজন্য আওয়ামী লীগ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দিয়ে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। সারা দেশের জনগণ এটি জানে।’ মুজিবুল হক বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিও সংসদে ছিল। বিএনপি ও অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টিও সংসদে ও রাজপথে আওয়ামী লীগের সব কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এবারের সংলাপে জাতীয় পার্টিকে এখনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দলটির ব্যাপারে আপত্তি এসেছে। এ আপত্তির পেছনে অভিযোগ হচ্ছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল জাপা। এমন প্রেক্ষাপটে সংলাপে জাপার ডাক পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, জাপাকে সংলাপে ডাকা হবে কি না, সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সংস্কার, নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংলাপ করছেন। গত শনিবার প্রথম দিনের সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ পাঁচটি দল এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ তিনটি জোট।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় গত ৫ আগস্ট। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে মিত্র বা সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা কখনো মন্ত্রিত্ব নিয়ে সরকারের অংশীদার হয়েছেন। কখনো সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে ‘গৃহপালিত’ উপাধিও পেয়েছিল জাপা। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও অংশ নিয়ে দ্বাদশ সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল দলটি। গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতনের পর জাতীয় পার্টির অতীত নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। এখন প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে ডাক পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সেই অতীত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জাপা নেতারা বলছেন, তাদের দলের একটি অংশকে আওয়ামী লীগের পুরো শাসন আমলেই সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাতে রাখা হয়েছিল। যখনই জাপা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করত, তখনই ওই অংশকে ব্যবহার করে দল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হতো। অতীতের ভূমিকা নিয়ে এখন জাপা নেতাদের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে হচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগের শাসনের সমালোচনা করেও বক্তব্য দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন গত ৮ আগস্ট। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার সপ্তাহ পর আগস্টের শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন তিনি। প্রথম দফার সেই সংলাপে জাপাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ৩১ আগস্ট দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ কয়েকজন নেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন। এবার সংলাপে দলটিকে নিয়ে ছাত্রনেতৃত্বের আপত্তির কারণে সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম সোমবার মধ্যরাতে দেওয়া স্ট্যাটাসে সারজিস লিখেছেন, জাতীয় পার্টির মতো মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালালদের প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে আলোচনায় ডাকে? এদিন একই সুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানালে কঠোর বিরোধিতা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এ সমন্বয়ক তার পোস্টে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে, আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।’
দলের অবস্থা নাজুক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের ৯ মার্চ জি এম কাদের এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জাতীয় পার্টি। এছাড়া ওই নির্বাচন ঘিরে দ্বন্দ্বের জেরে দলটি ছেড়ে যান অন্তত ৬৬৮ নেতাকর্মী। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ে দলের সাংগঠনিক শক্তিতে। বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা বলেন, সর্বশেষ ভাঙন এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের অবস্থা কিছুটা খারাপ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগ শীর্ষনেতাদের নামে মামলা হলে হাতে গোনা কয়েকটি জেলা বাদে বেশিরভাগ জেলায়ই কোনো কর্মসূচি পালন করা যায়নি। সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিই দলটির বর্তমান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন সাংগঠনিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে জোর দিচ্ছি। দেশের জনগণ জাতীয় পার্টির সঙ্গে ছিল। আমাদের সমর্থকরা বিগত সব নির্বাচনে আমাদের পাশে থেকেছে। কেন্দ্রে ও জেলায় জেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। নতুন প্রজন্মকে সামনে রেখে আমরা আমাদের রাজনৈতিক করণীয় ঠিক করব।’