ছাত্র আন্দোলন ও আগামীর বাংলাদেশ
ছাত্র আন্দোলনে হাসিনা সরকার বাহিনী ও রাজনৈতিক দল ব্যবহার করে শিশু কিশোরদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষ সহ বিশ্ববিবেক ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেই সাথে এই ঘৃণ্য আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সকল প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে। ইতোমধ্যেই দেশের ভেতরে কার্ফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মাঠে নামিয়ে আর্মি নিজেরা গুলি করে কিছু জায়গায় সামরিক পাহারায় পুলিশ ও দলীয় কর্মী ব্যবহার করে হত্যা এবং আলো নিভিয়ে ব্লক রেইড দিয়ে পরিস্থিতি অনেকাংশে সামাল দিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশ কিছুটা শান্ত হলেও বিশ্ব বিবেক কিন্তু থেমে থাকেনি, তারই ধারাবাহিকতায় প্রফেসর ইউনুসের আহ্বানসহ বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিবিদ সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অনেক দফা দাবি থেকে ১ দফা দাবিতে রুপান্তরিত হয়। ঠিক তখনই হাসিনা ও তার আন্তর্জাতিক বন্ধুরা মিলে সারাবিশ্বে প্রচার করতে থাকে তাদের পুরনো তত্ত্ব বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থান হচ্ছে। সেটি দেখানোর জন্য জামায়াত ইসলামকে নিষিদ্ধ করা হয়। যেহেতু, বিশ্ববাসী ছাত্র আন্দোলন দমনে হাসিনার নির্মমতা নিয়ে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিল, তাই পৃথিবীর নেতারা হাসিনা ও তার দোসরদের এই ফাঁদে পা দেয় নি। হাসিনার এই কথা তারা বিশ্বাসও করেনি। ঠিক তখনি হাসিনা ও তার দোসররা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তারা ক্ষমতায় থাকতে না পারলে এমন এক ব্যবস্থা করবে, যাতে বিশ্ববাসী দেখতে পায় যে হাসিনা সঠিক ছিল এবং বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আর এই কাজটা করার জন্য পলাতক হাসিনাকে সহায়তা করার জন্য অঙ্গিকারাবদ্ধ হয় হাসিনার দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন সামরিক বেসামরিক আমলারা ও জুডিশিয়ারির একটা অংশ।
হাসিনা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরপরই এই ইসলামী গোষ্ঠীগুলো বুঝে না বুঝে বিভিন্নদিকের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যেই সংখ্যালঘু আক্রমণ থেকে শুরু থেকেই রাজপথ ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমাজে ও শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় হিজতুব তাহরির মত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন কে প্রকাশ্যে ঢাকার রাজপথ কাঁপাতে থাকে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতারা জেল থেকে মুক্ত হতে থাকে। বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ঢাকায় বড় বড় ছাত্র মহাসম্মেলনের আয়োজন করে। এদের প্রত্যেকের ধারণা হয়, যেহেতু ওরা সরকারি বিভিন্ন যায়গা থেকে বাঁধা না পেয়ে বরং সহায়তা পেয়েছে, তাহলে এই সুযোগে বাংলাদেশের সকল মধ্যপন্থী রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জনমনে এক ধরনের জায়গা করে নেবে, যাতে করে তারা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় চলে আসলে সবাই যেন এটি মেনে নেয় যে- তারা সত্যিই জনগনের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ওরা আসলে বুঝেনি হাসিনা ও তার দোসররা আন্তর্জাতিক বন্ধুদের খেলা আসলে যেভাবেই হোক আন্তর্জাতিক মহলে প্রমাণ করা বাংলাদেশ ইসলামী মৌলবাদীদের দখলে, সেটা যদি আগে রাজপথে প্রমাণিত হয় তাও হবে। আবার যদি তথাকথিত ভোটের মাধ্যমে হয় তাও হবে। তথাকথিত ভোটের মাধ্যমে বললাম এই কারণে যে, প্রমানিত ভোট চোর নির্বাচন কমিশন কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, কেন হাসিনা ও তার আন্তর্জাতিক বন্ধুরা চায় ইসলামী গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতা প্রদর্শন করুক? এইটা বুঝতে হলে আপনাকে দৃষ্টি দিতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের মিশরের দিকে। হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্তের বিপ্লবের মাধ্যমে। এক বছরের মাথায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসে মুরসি, ঠিক তখনি ইসলামী গোষ্ঠীগুলো মুরসিকে ঘিরে ধরে মিসরকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করে। বেচারা মুরসি বুঝতেই পারেনি মুসলিম ব্রাদারহুড আসলে ইসরাইলি ইহুদিদের খপ্পরে পড়ে গেছে। মুরসি যখনি মিশরের সংবিধান পরিবর্তন করে ইসলামী ভাবধারা গ্রহন করল, ঠিক তখনই ঘাপটি মেরে থাকা সেনাবাহিনী ইসরাইলি সমর্থনে ছোবল মারলো মিশরের জনগণের উপর। গত ১০ বছর মিশরবাসি আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি নামক সামরিক শাসনের অধিনে চলছে। এর মধ্যে সেই মুসলিম ব্রাদারহুড কিন্তু আর টু শব্দটিও করেনি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি রহস্যজনক ভাবে কারাগারে মারা যায়। মিসরবাসীর গণতন্ত্রের স্বপ্ন ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুঃস্বপ্ন হিসেবে থেকে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।
অতএব এদেশের গণতন্ত্রকামী সকল মানুষের উচিত তার আশে পাশে এমন ভাবে চোখ, কান খোলা রাখা- যাতে ইসলামী মৌলবাদীদের উত্থানের অযুহাতে যেন কেউ আবার বাংলাদেশের উপর সামরিক শাসন চাপানোর ষড়যন্ত্র করতে না পারে! হাসিনার একমাত্র আন্তর্জাতিক বন্ধু ভারত যার পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলীদের কাছে। ইসরাইলিরা যুগ যুগ ধরে ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর সাথেই বসবাস করে মধ্যপ্রাচ্যে টিকে আছে, এই ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কারা ইসরাইলের বন্ধু আর মুসলমানের বন্ধু সেই প্রমাণ বের করা খুবই কঠিন।
লেখক : মোহাম্মদ মোবাশ্বের হোসেন, ভূরাজনীতি ও বাণিজ্য বিশ্লেষক।