মিজান রহমান

  ০৩ জুন, ২০২৩

দাঁড়াতেই পারছে না জাপা

ছবি : সংগৃহীত

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি-জাপায় পদ-পদবি নিয়ে চলছে চরম বিরোধ। এই বিরোধ ঠেকেছে সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ পদ নিয়ে। ফলে দলীয় সংসদ সদস্যরা রয়েছেন দোটানায়। তারা বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জিএম কাদের উভয়ের মন রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে পদ-পদবি নিয়ে বিরোধে দাঁড়াতেই পারছে না জাপা।

এদিকে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে ‘বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ’ পদ থেকে সরিয়ে দিতে স্পিকারের কাছে চেয়ারম্যান জিএম কাদের চিঠি দিয়েছেন। অন্যদিকে রাঙ্গাকে পদে রাখতে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও চিঠি দিয়েছেন। দেবর-ভাবির এই বিরোধ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই দলের পদ-পদবি নিয়ে দেবর-ভাবির লড়াই শুরু হয়। দলের চেয়ারম্যান পদ, বিরোধীদলীয় নেতার পদ এবং বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদসহ নানা বিষয়ে ভাবি রওশন এবং দেবর কাদেরের মধ্যে মতবিরোধ চলতে থাকে। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। ওই বছর অক্টোবরে ফখরুল ইমামকে বিরোধী দলের চিফ হুইপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের ওই সিদ্ধান্ত স্পিকারের দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পরবর্তী সময়ে ওই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এনে পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধী দলের চিফ হুইপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের স্পিকারকে চিঠি দিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গার পরিবর্তে কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধী দলের চিফ হুইপ পদে স্থলাভিষিক্ত করার অনুরোধ জানান। পরে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ পাল্টা চিঠি দিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদে বহাল রাখার অনুরোধ করেন স্পিকারকে।

# পদ-পদবির বিরোধ # সংসদ সদস্যরা দোটানায় # নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা # চিফ হুইপ পদ নিয়ে দেবর-ভাবির আলাদা চিঠি।

জাপার উভয়পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীর্ষ নেতৃত্বে বিরোধের কারণে পার্টির সংসদ সদস্যরাও দোটানায় রয়েছেন। তারা রওশন ও জিএম কাদের উভয়ের মন রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদ এককভাবে সম্মেলন করলে বেকায়দায় পড়তে পারেন জিএম কাদের।

দলীয় সূত্র জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শুরু হয়েছে দুই বলয়ের কর্মকাণ্ড। চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে মাইনাস করে ফের দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন করতে তৎপর রওশন এরশাদপন্থিরা। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কার নেতৃত্বে হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

সূত্র আরো জানায়, জাপার প্রধান রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশীদকে প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রধান করে আট বিভাগকে সমন্বয় করে গঠন করা হয়েছে সাতটি বিভাগীয় সাংগঠনিক সমন্বয় কমিটি।

রওশনপন্থি নেতারা জানান, দলের অন্তত ২০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে বাদ দেওয়া, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে পৃথক জোটে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে জিএম কাদেরের পরিকল্পনা ও এরশাদপুত্র সাদকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখাই বিরোধের মূল কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে রওশন এরশাদ এসব বিষয় সমাধানে জিএম কাদেরকে লিখিত চিঠি ও তার সঙ্গে সরাসরি কথা বললেও দলে বহিষ্কৃতদের ফেরাতে নারাজ তিনি। সেই সঙ্গে জাপার মূল নেতৃত্ব সাদের কাছে তুলে দিতেও সম্মত নন।

এদিকে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে ‘বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ’ পদ থেকে সরিয়ে দিতে ও রাখতে স্পিকারের কাছে জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ পাল্টা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে জিএম কাদের রাঙ্গাকে ‘চিফ হুইপ’র পদ থেকে সরিয়ে ফখরুল ইমামকে বানানোর প্রস্তাব করেছেন। আর রওশন এরশাদ রাঙ্গাকেই বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদে রাখার চিঠি দিয়েছেন। শুক্রবার (২ জুন) কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তারা চিঠি দেন। এ নিয়ে খোদ জাতীয় পার্টিতেই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

দলীয় সূত্রগুলো বলেছে, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে জাপার শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হলে কাদেরকে মাইনাস করে সম্মেলন করবেন রওশনপন্থিরা। তবে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হবে না। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদ দেওয়া হতে পারে তাকে।

এ বিষয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও সংসদের বাইরে কিছু বক্তব্য বিবৃতিতে ব্যস্ত থাকছে। ফলে সাংগঠনিক শক্তি তৈরিতে ভাটা পড়ছে। এই বিরোধ এখনই মিটিয়ে না ফেলতে পারলে সংসদ নির্বাচনে বড় মাশুল দিতে হবে। জাতীয় পার্টি কারো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নয়, নেতাকর্মীরাই দলের প্রাণ। এটা শীর্ষনেতাদের উপলব্ধি করতে হবে।

রওশনের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেছেন, দলীয় নেতাকর্মীরা চাইলে গঠনতন্ত্র মোতাবেক এবং দলের বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে কাউন্সিল বা বিশেষ কাউন্সিল আহ্বান করতে পারেন রওশন এরশাদ। তাকে গত কাউন্সিলেই এই ক্ষমতা কাউন্সিলারই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়েছেন। কেননা, তিনি জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাশে থেকে দলের সুদিনে দুর্দিনে কাজ করেছেন।

জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দশম জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে সারাদেশে জাপা শক্তিশালী করতে মাঠে নেমেছে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে বিভাগীয় সাংগঠনিক সমন্বয় কমিটি। ১৮ মে থেকে শুরু হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সমন্বয় কমিটির জেলা-উপজেলা সফর শেষ হবে ১৫ জুনের মধ্যে।

দলীয় সূত্র বলছে, রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা একসময় জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে ২০১৮ সালে রাঙ্গাকে দলের মহাসচিব করা হয়েছিল। এরশাদ প্রয়াত হওয়ার পর জাপাতে জিএম কাদের-রওশন এরশাদ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। এই দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় পার্টির নেতৃত্ব থেকে কাদেরকে সরাতে গত বছরের গত ৩১ আগস্ট থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন সম্মেলন ডাকেন। পরদিন রওশনকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করে স্পিকারকে চিঠি দেয় জাপার সংসদীয় দল। সেই চিঠি পৌঁছে দিয়েছিলেন রাঙ্গাই। কিন্তু পরে চিঠির শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

স্পিকারের দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২৩ মে তারিখে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মসিউর রহমান রাঙ্গাকে পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদে রাঙ্গাকে সরিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদকে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করায় ফখরুল ইমামকে এই পদের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, প্রেসিডিয়াম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা চিঠি জমা দিয়ে আসেন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের চিঠির খবর আমার জানা নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে চিফ হুইপ পদে বহাল রাখতে বলা হয়। অন্যদিকে জি এম কাদের চিঠি দিয়ে রাঙ্গাকে সরিয়ে ফখরুল ইমামকে স্থলাভিষিক্ত করতে বলা হয়। এ বিষয়ে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দাঁড়াতেই পারছে না জাপা,জাতীয় পার্টি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close