বদরুল আলম মজুমদার

  ১৫ মার্চ, ২০২৩

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আমিনুলে তছনছ পশ্চিম ছাত্রদল

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের আজ্ঞাবহ সংগঠনে পরিণত হয়েছে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল। আমিনুলের ব্যক্তিগত প্রটোকল ছাড়া পশ্চিম ছাত্রদল আশাব্যঞ্জক সাড়া ফেলতে পারেনি বলে অভিযোগ সাবেক নেতাদের। পশ্চিম ছাত্রদলের পাশাপাশি তিনি উত্তর ছাত্রদলেও একটি বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। হামলা-মামলার শিকার নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করে না এমন ছেলেদের থানা ও ওয়ার্ডের সভাপতি-সম্পাদক করতে চাপ তৈরি করছেন সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে। উত্তর বিএনপির একক আধিপত্য নিতে সচেষ্ট এ নেতা একই সঙ্গে অঙ্গ ও সহযোগী দলগুলোতেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অঙ্গ ও সহযোগী দলগুলোতে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে ইচ্ছেমতো নেতা বানাচ্ছেন, আবার কোনো কারণ ছাড়াই ভেঙে দিচ্ছেন কমিটি। এ কাজ করতে তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অকুণ্ঠ সমর্থন পান বলে জানা গেছে।

দলটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আমিনুল উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব হওয়ার আগেই ৫১ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি মাত্র ১০ মাস দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। কী কারণে সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি আজো। তবে অনেকে জানান, আমিনুল পশ্চিম ও উত্তর ছাত্রদলকে নিজের মতো সাজাতে পশ্চিমের কমিটি ভেঙে দেন। উত্তরে তার পছন্দের ‘মাই ম্যান’ কমিটিতে থাকায় এটিতে হাত দেননি আমিনুল। তবে সম্প্রতি এই কমিটি ভাঙার জন্যও পর্দার আড়ালে কলকাঠি নাড়ছেন সংশ্লিষ্টরা।

মূলত আমিনুল বিএনপি উত্তরের সদস্য সচিব হওয়ার পর পশ্চিমের কমিটি নিজের মতো সাজাতে উদ্যোগী হন। তার এ খায়েশ পূরণে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সম্পাদক। তারা ১০ মাসের মাথায় ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ভেঙে যে ৭ সদস্যের কমিটি দিয়েছেন তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। কথিত আছে, ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি এখনো আমিনুলের হয়েই কাজ করছেন বলে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, ৭ সদস্যের কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে এমন একজনকে আনা হয়েছে যিনি ওয়ার্ড থেকে থানার সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু আমিনুলের গ্রিন সিগন্যালে থানা টপকিয়ে হয়ে যান নগর পশ্চিমের সম্পাদক। ছাত্রদলের রাজনীতির করতে এসে এমন পুরস্কার পাবেন তা কখনো ভাবতেও পারেননি বর্তমান সম্পাদক জুয়েল হোসেন রাজ। রাজ মূলত ভোলার ছেলে হিসেবে আমিনুলের দেহরক্ষীর মতো কাজ করতেন বলে একাধিক ছাত্রনেতা নিশ্চিত করেছেন। রাজকে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পদে আনার বিষয়টি আটকে দেয় খোকন শ্যামল কমিটি। রাজ বিবাহিত হওয়ায় এবং তৎকালীন কমিটি সেটির প্রমাণ পাওয়ায় তাকে ছাত্রদলের কমিটিতে নেওয়া হয়নি। এর কিছুদিন পরেই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসেন শ্রাবণ-জুয়েল। তারা দায়িত্ব পাওয়ার পরই ৫১ সদস্যের কমিটি ভেঙে ৭ সদস্যের কমিটি দেয় কেন্দ্র। সেই কমিটিতে বিবাহিতের কারণে অযোগ্য রাজকে প্রাইজ পোস্ট হিসেবে পশ্চিমের সাধারণ সম্পাদক বানান শ্রাবন-জুয়েল।

একই কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ নাসিরের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। জানা গেছে, তিনি সভাপতি হওয়ার আগে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। মহানগরের তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতারা তাকে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। তার বাড়ি ও নাসিরের বাড়ি একই এলাকায় হওয়ায় অব্যাহতি না পেয়ে তিনিও প্রাইজ পোস্ট পান সভাপতি হিসেবে। বর্তমানে সাইফ-জুয়েল আমিনুলের এজেন্ডায় কাজ করছেন না বলে জানা গেছে।

অপরদিকে একই ইউনিটের সহ-দপ্তর সম্পাদক ইকবাল হোসেন সোহেলের বিরুদ্ধেও কথা বলছেন সাবেক ছাত্রনেতারা। সোহেল আগে কখনোই রাজনীতি করতেন না। তিনি মিরপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে ক্লিনার হিসেবে চাকরি করতেন। এরকম একটি ভিডিও পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমেও। সোহেল যে অফিসে চাকরি করতেন, সেখানে যাতায়াত করতেন বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল। এই সোহেলের গ্রামের বাড়িও ভোলায়। পরিচয়ের সূত্র ধরে সোহেল ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে আমিনুলের সঙ্গে। চাকরি ছেড়ে সোহেল আমিনুলের স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে নানা ফুটফরমাশ খাটতে থাকেন সোহেল। এর আগে কোনো রাজনৈতিক পদ না থাকলেও সোহেলকে এক চিঠিতেই সহ-দপ্তর সম্পাদক বানিয়ে নেন আমিনুল। সোহেলের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আছে যে, তিনি আমিনুল হকের হয়ে মহানগর উত্তর বিএনপির বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তাদের আমিনুলের কাছাকাছি পৌঁছে দেন। নেতাও বানিয়ে নেন। এ কাজ করে সোহেল এরই মধ্যে গ্রামে জমিজমা কিনেছেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া গত ৬ মার্চ ছাত্রদল কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে আবদুল কাদের নামে একজনকে সহ-দপ্তর সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়। সহ-দপ্তর সম্পাদক মনোনীত করার আগে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল হাসান রাজসহ কমিটির অন্য নেতারা জানতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিজ্ঞপ্তির পরে তাৎক্ষণিক ওয়েস্ট নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জুয়েল হাসান রাজ লেখেন- ‘কিছুই বলার নেই, সংগঠন এখন বাপ-দাদার সম্পত্তির মতো হয়ে গেছে। আর পকেটে কিছু টাকা হলেই পদ পাওয়া সহজ হয়ে যাচ্ছে।’ এমন কথোপকথন পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমেও। আরেকটি স্কিনশর্টে দেখা গেছে, মহানগরের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম ইফাদ লিখেছেন- ‘অভিনন্দন জানিয়েছি ঠিক আছে, কিন্তু আমি চিনতে পারলাম না তাকে। নতুন সহ-দপ্তর সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এটাই তার প্রথম পদ, তার আগে তিনি ছাত্রদলের কোনো পদে ছিলেন না।

মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের একটি থানার একজন নেতাকে ফুল দিচ্ছেন বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল। কারামুক্ত হওয়ায় তাবিথ আহমেদকে ফুল দেওয়া হয় রকিবুল ইসলামের হাত দিয়ে। তাবিথ আহমেদ মিরপুর থানা ছাত্রদলের স্থগিত কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন। বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সংবাদে দেখা যায়, গত নভেম্বরে তাবিথ আহমেদসহ দুজনকে ১৩১ বোতল ফেনসিডিলসহ কুমিল্লা শহরের একটি চেক পোস্টে আটক করে র‌্যাব-১১। পরে শহরের কোতোয়ালি থানায় একটি মাদক মামলায় আটক দেখানো হয় তাদের। কয়েক মাস পর জামিনে মুক্তি পায় রাশেদসহ তার সহযোগীরা। পরে তাদের ফুল দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ডা. বকুলের কাছে। এ বিষয়ে রকিবুলের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, কত নেতাকর্মীই তো কত দিক থেকে আসে, আসলে ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি চিনি না।

মহানগরের ৭ সদস্যের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ২ নং যুগ্ম সম্পাদক আতিক মোহাম্মদ হাবীব চৌধুরী দায়িত্ব পাওয়ার ১০ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত দলীয় কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি তাকে। নিষ্ক্রিয় থাকার পরও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমিনুল হকের অনুসারী হওয়ায় তিনি এ সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

অভিযোগগুলোর বিষয়ে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে অন্য একজন ফোন ধরে ব্যস্ততার কথা জানান। অভিযোগের বিষয়ে নগর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি,পশ্চিম ছাত্রদল,বিএনপির আমিনুল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close