বদরুল আলম মজুমদার

  ০৩ অক্টোবর, ২০২২

জামায়াত-বিএনপিতে বাড়ছে টানাপোড়েন

ফাইল ছবি

বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না জামায়াতের। তাই দলটিকে এখন আর আগের মতো বিশ্বাস করছে না বিএনপি। গত দুই মাস থেকে দল দুটির মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও টানাপোড়েন বেড়েই চলছে। বিএনপির সন্দেহের মূলে রয়েছে জামায়াতের সুবিধাদী আচরণ এবং কয়েক বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির সঙ্গে শক্তভাবে না থাকা। অপরদিকে জামায়াত বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মাঝে থেকে রাজনীতির সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে চায় বলে মনে করছে বিএনপির একাধিক নেতা। যদিও এসব দাবিকে সরাসরি অস্বীকার করে বিএনপি জোটে থাকার কথাই পুনর্ব্যক্ত করছেন জামায়াত নেতারা। এ বিষয়ে দলের আমিরের একটি বক্তব্য ভাইরাল হলেও জামায়াত নেতারা এটিকে ব্যক্তিগত মত বলেই আখ্যা দিয়েছেন। তবে জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, স্বনামে রাজপথে নেমে নতুন করে সরকারের রোষানলে পড়তে চায় না তারা। সামনের দিনগুলোতে দলটি অন্য দলের পতাকার নিচে থেকে সরকারবিরোধী অবস্থান ধরে রাখবে। আর বিএনপি জামায়াতের এমন অবস্থানকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখছে।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, নিজেদের সুবিধা আদায় করতেই বিএনপির কাঁধে ভর করে রাজনীতি করতে চায় জামায়াত। অতীতেও তারা এমনটা করে আসছে, বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল জামায়াত। সামনের দিনগুলোতেও জামায়াত বিএনপির জন্য বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিএনপির অনেকে বলছেন, এমন বিবেচনা থেকেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জামায়াত নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। জামায়াত ভেতরে ভেতরে সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে- এমন কথা শুধু টুকু নয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতাই মনে করেন। তবে, নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে এমন কথা না বললেও জামায়াত নিয়ে তারা দলের অভ্যন্তরে প্রায়ই কথা বলেন। নেতারা বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে জামায়াতকে আর সঙ্গে নিয়ে চলতে চান না। তবে দলের একটি কট্টর ডানপন্থি অংশ বরাবরই জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নেন, কোন যুক্তিতর্ক ছাড়াই। অতীতের মতো সেই অতি ডানপন্থি নেতারা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও জামায়াতকে বিএনপির সঙ্গেই দেখতে চায়।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বিএনপি-জামায়াতের বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, জামায়াত এখনো বিএনপির সঙ্গে জোটে আছে। যতক্ষণ জোটে আছে তত সময় পর্যন্ত বিশ্বাস না করার কারণ নেই। আর জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি বা জামায়াতের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তার মিত্রদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের চেষ্টা করছে। সে জায়গা থেকে বিএনপি বিশ্বাস করে, জামায়াতও সরকারের বিপক্ষে রাজপথে সরব থাকবে। এটা নিয়ে দ্বিধার কিছু দেখছি না। তবে জামায়াত বিষয়ে ইকবাল হাসান টুকুর মন্তব্য নিয়ে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

ধীরে ধীরে বিএনপি জামায়াতকে দূরে ঠেলে দিতে চায়, এক্ষেত্রে জামায়াতের অবস্থান কি হবে, এ বিষয়ে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম প্রতিবেদককে বলেন, আমরা এখনো বিএনপি জোটে আছি। জোট যত সময় পর্যন্ত আছে ততক্ষণ পর্যন্ত অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখছি না। তবে এটা সত্য সাম্প্রতিক সময়ের কিছু বক্তব্য নিয়ে দুই দলেই কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবতারণা হয়েছে। আশা করি সামনে এগুলো আর থাকবে না। নিজ নামে বা ব্যনারে জামায়াত সরকারের বিপক্ষে রাজপথে থাকবে কি না এমন প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, এটা বলা কঠিন, সময় এবং পরিস্থিতি বলে কখন কি করতে হবে।

দল দুটি এখনো জোটে থাকলেও দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। দু’দলের প্রায় দুই যুগের সুসম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এতদিন পর্দার আড়ালে ইস্যুটি চাপা থাকলেও তা এখন প্রকাশ্যে চলে আসছে। সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং এর আগে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে দু’দলের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে। সরকারবিরোধী সম্ভাব্য বড় আন্দোলনের আগে দীর্ঘদিনের মিত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে দু’দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ বাড়ছে।

গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি সমাবেশে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘জামায়াতও উর্দু শব্দ, আওয়ামী লীগও উর্দু। দুটি একসঙ্গে মিলবে ভালো। আওয়ামী লীগ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করেনি। তাহলে কি তলে তলে তাদের পরকীয়া প্রেম চলছে? এর অর্থ, আওয়ামী লীগ গোপনে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। সেজন্য নিবন্ধন বাতিল করে না। ’

টুকুর ওই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে জামায়াত। টুকুর বক্তব্যকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে দলটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘অসংলগ্ন’ বক্তব্য থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয় দলটির পক্ষ থেকে।

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনের পর দলটির কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে এ রকম বিবৃতির ঘটনা এটাই প্রথম। তবে টুকুর বক্তব্য এবং জামায়াতের বিবৃতির বিষয়ে বিএনপি নীরব। এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা মুখ খুলছেন না।

এদিকে জামায়াতের বিবৃতির পরই বিএনপি সমর্থিত প্রভাবশালী পেশাজীবী নেতা ও বন্ধ হয়ে যাওয়া আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও টুকুর কঠোর সমালোচনা করেছেন। লন্ডন থেকে অনলাইনে প্রকাশিত ওই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তিনি টুকুকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন। তার ওই সমালোচনাকে ভালোভাবে নেননি বিএনপির হাইকমান্ড। অনেক নেতা তাকে জামায়াতপন্থি হিসেবে মনে করছেন। তবে বিএনপির অভ্যন্তরেও টুকুবিরোধী নেতাদের একটি অংশ এই ইস্যুতে অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যে সরব হয়ে উঠছেন। তবে জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিএনপি নেতারা টুকুর বক্তব্যকে সময়োপযোগী বলে সাধুবাদ দিচ্ছেন। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক দলকে নিয়ে পথচলার বিরোধিতা করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, টুকু যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। এটা দলের বক্তব্য নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি দলীয় ফোরামে আলোচনা না করেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। বক্তব্যের খাতিরে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই এটা নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি না হয় সেজন্য তারা কোনো মন্তব্য করবেন না।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নই আসে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এভাবে কথা বলতে পারেন না। তার এই বক্তব্য জামায়াতের নেতাকর্মীদের মনে আঘাত দিয়েছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,জামায়াত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close