বদরুল আলম মজুমদার

  ১৯ মে, ২০২২

জাফরুল্লাহর প্রস্তাব সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি : সংগৃহীত

জাতীয় সরকার প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। আর কীসের ভিত্তিতে এ প্রস্তাব তার কোনো পরিষ্কার ধারণা তিনি দিতে পারেননি বলে মনে করেন দলটির নেতারা।

‘জাতির সংকট নিরসনে জাতীয় সরকার’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব গত রবিবার গভীর রাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার প্রস্তাবে ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন এবং এর পরের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে।

জাফরুল্লাহর এ প্রস্তাবের বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় এমন একটি সরকারের প্রস্তাব সব দলের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম দিতে পারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এ জাতীয় একটি ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কী সরকার নেবে; না আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হবে তা পরিষ্কার নয়।

অন্যদিকে, জাতীয় সরকারে আসতে পারেন বলে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তারা আদৌও এমন একটি সরকারে থাকবেন কি না, তা বলা যাচ্ছে না। তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ যেসব নেতারা জাতীয় সরকার নিয়ে আলোচনা করছেন তারা প্রস্তাবটিকে সামনে এনে জনমত যাচাই করতে চাচ্ছেন। তার এ প্রস্তাবের পেছনে দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রভাবশালী বিদেশি কূটনৈতিকদের সমর্থন থাকতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে বিএনপি এমন একটি সরকারকে সমর্থন দেবে কি না এ বিষয়ে নেতারা এখনই মুখ খুলতে রাজি নয়।

দলের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, জাফরুল্লাহ প্রস্তাবটির পেছনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পক্ষের সমর্থন থাকতে পারে। তবে তিনি কীভাবে সরকারটি প্রতিষ্ঠা করতে চান তা স্পষ্ট করেননি। রাজপথে দাবি আদায় করে এই সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন, না সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে তার এই পরিকল্পনার সরকার প্রতিষ্ঠা করবে তা পরিষ্কার নয়। তবে জাফরুল্লাহর মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ বিএনপির বেশ কিছু নেতার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা এবং তারেক কন্যা জায়মা রহমানের নাম নিয়ে এসে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করা হয়েছে।

রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে বর্তমান সরকারের পতনের পর দুই বছরের জন্য একটি জাতীয় সরকারের কথা বলছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের পর একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যেসব রাজনৈতিক দল বিএনপিকে সঙ্গ দেবে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করলে সেই সব দলের নেতাদের নিয়ে জাতীয় সরকার করা হবে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকারের কথা বলা হলেও নতুন করে জাফরুল্লাহর জাতীয় সরকার প্রস্তাব আসায় বিএনপি যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখছে।

দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এ নিয়ে বিএনপিতে এক ধরনের অস্বস্তিও কাজ করছে। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বিগত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মতো একটা কিছু হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ডা. জাফরুল্লাহ যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেখানে ক্ষমতাসীনদের চাওয়ারও একটা মিল পাওয়া গেছে বলে মনে করে নেতারা।

বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা দেওয়া হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এসব মামলা প্রত্যাহার নিয়ে কোনো কথা বলেননি ডা. জাফরুল্লাহ। উল্টো তার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক কর্মী ও আলেমদের জামিন নিশ্চিত করে এক বছরের মধ্যে তাদের বিচার শেষ করে রায় কার্যকর করা হবে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলের নেতারা।

এ দিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জাতীয় সরকারের রূপরেখার দিকে ইঙ্গিত করে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি অনেকে অনেক সরকার বানানোর কথা বলছেন। তাদের বলব, তার আগে তো শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে হবে। এই সরকারকে বিদায় না করে কীভাবে আরেকটি সরকার হবে? বরং এ সরকারের ফলে বর্তমানে যে ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতায় আছে, তারাই লাভবান হবে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে নারী ও যুব উন্নয়নে তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান এবং পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের নাম প্রস্তাব করেছেন।

তবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন শামা ওবায়েদ। তিনি বলেন, বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে দলের সিদ্ধান্তই আমার কাছে চূড়ান্ত। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে প্রস্তাব করেছেন, সেটা তার কল্পনাপ্রসূত। এর সঙ্গে আমার কোনো রকম সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করেনি বলে জানান শামা ওবায়েদ। গণমাধ্যম থেকে এই প্রস্তাবের কথা জেনেছেন বলে জানান তিনি।

জাতীয় সরকার প্রস্তাবের বাইরে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিএনপির সন্দেহের আরেকটি কারণ হচ্ছে বিএনপির ঐক্য প্রচেষ্টার মধ্যেই পাঁচটি দল ও দুটি সংগঠন নতুন রাজনৈতিক ‘মোর্চা’ গঠনে বৈঠক করেছে, যাদের অধিকাংশের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের আলোচনা চলছিল। এগুলো হচ্ছে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

অপরদিকে, জাফরুল্লাহ এমন প্রস্তাবের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিছেয়েন আওয়ামী লীগ নেতারা। গত মঙ্গলবার শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, কেউ কেউ জাতীয় সরকারের দিবাস্বপ্ন দেখছে, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল কেবল নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জাতীয় সরকারের নামে যারা আজ আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, শেখ হাসিনার একজন কর্মী বেঁচে থাকতে তাদের রাজপথ দখল করতে দেব না।

শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে অসাংবিধানিক সরকার গঠনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে দাবি করে মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন। এরা করা? এরা এক-এগারোর কুশীলব। যারা জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তারাই অশুভ পথ খুঁজে বেড়ায়। অশুভ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাফরুল্লাহ,বিএনপি,জাতীয় সরকার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close