গাজী শাহনেওয়াজ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২২

নাসিক নির্বাচন : বুদ্ধির খেলায় হারলেন তৈমূর

দুই মেয়র প্রাথী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচনী পোস্টার। ছবি : বিবিসি

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের। তিনি শামীম ওসমান বলয়ের ছত্রছায়ায় থেকে জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু তা শেষপর্যন্ত পূরণ হয়নি। তৈমূর হেরে যান বুদ্ধির খেলায়!

কেউ বলছেন বিএনপির কর্মীরা তার পক্ষে নামেননি। আবার কেউ নামলেও সেভাবে কাজ করেননি। সবচেয়ে বড় বিষয়, তৈমূর কোনো ব্যানারের প্রার্থী তাও জানা যায়নি ভোটের দিন পর্যন্ত। সব মিলিয়ে প্রার্থিতা নিয়ে ধূম্রজাল ছিল নির্বাচনজুড়েই। আবার কাউন্সিলর পদেও এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ২৭ ওয়ার্ডের ৯টিতে বিএনপি, ১৪টিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী জয়ী হন।

স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপির সাবেক এমপি ও দলীয় কর্মী-সমর্থকরাও ছিল না তার পাশে। কম গ্রহণযোগ্য ও নির্দিষ্ট ভোটার ব্যাংক নেই সদরের এমন দু-একজন নেতা পাশে ছিলেন শুধু। ফলে এসব নেতার ভোটব্যাংক না থাকায় ভূমিকা রাখতে পারেননি।

১৯২ কেন্দ্রের কোনোটিতে নৌকার চেয়ে হাতি বেশি ভোট পেয়েছে দু-একটিতে। এর মধ্যে আদর্শ স্কুলের দুটি কেন্দ্রে নৌকা বেশি ভোট পেয়েছে। তবে শামীম ওসমান যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন সে কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে হাতি। ভোটকেন্দ্র-২-এ নৌকা পেয়েছে ৪৯২ ভোট। হাতি পেয়েছে ৩৫২ ভোট। এই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন শামীম ওসমান। আর ভোটকেন্দ্র ৩-এ নৌকা পেয়েছে ৩৬২ ভোট। হাতি পেয়েছে ৬৮০। সব মিলে আদর্শ স্কুলে জয়ী হয়েছে হাতি।

শামীম ওসমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, উত্তর চাষাঢ়া তার পারিবারিক এলাকা। এবারই প্রথম তিনি মাজদাইরের আদর্শ স্কুলে ভোট দিয়েছেন। তিনি এখানকার নতুন ভোটার। সিটি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে তিনি ভোটার এলাকা পরিবর্তন করে এখানকার ভোটার হয়েছেন। এটি মূলত হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের এলাকা। তবে তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সেখানে নৌকা জিতেছে।

তৈমূর আলম খন্দকার পুরোদস্তুর রাজনীতিক হলেও বুদ্ধির খেলায় হেরেছেন বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয় সাংবাদিকরা। তারা বলছেন, ওসমান পরিবারের প্রার্থী এই পরিচয় ছিল। যদিও আওয়ামী লীগের চাপে নীরব হয়ে যান হঠাৎ সরব শামীম ওসমান।

আর দুই নম্বর কারণ তৈমূর আলম বিএনপির প্রার্থী কি প্রার্থী না—এটি খোলাসা করতে পারেননি তিনি। এটি নিয়ে পুরো নির্বাচনজুড়ে ছিল ধূম্রজাল। বিএনপির কর্মীরা তার পক্ষে নামেননি। আবার কেউ নামলেও ছিল না অ্যাক্টিভ। পরিষ্কার করতে পারেননি তিনি বিএনপির প্রার্থী—এটাও তার পরাজয়ের কারণ। আর বিএনপির প্রতীক ধানের শীষও পাননি।

আর তৃতীয় কারণ নারায়ণগঞ্জ সদর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এই তিনটি এলাকার প্রভাবশালী তিন এমপির সমর্থন ছিল না হাতির পক্ষে। গিয়াসউদ্দিন সিদ্ধিরগঞ্জের প্রভাবশালী সাবেক এমপি। ওই এলাকায় তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বন্দরের সাবেক এমপি আবুল কালাম; ওই এলাকায় তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। আর সদরের সাখাওয়াত হোসেন তিনি এই এলাকায় জনসমর্থনে এগিয়ে থাকেন সবসময়। ২০১৬ সালে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তৈমূর আলমের চেয়ে ৩ হাজারের মতো বেশি ভোট পেয়েছিলেন। সর্বদলীয় সমর্থন দাবি করা তৈমূরের পাঁচ বছরের ব্যবধানে ভোট বাড়ার বদলে কমেছে। নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সাবেক এই তিন উল্লেখযোগ্য এমপি ও নেতা হলেও তার পাশে ছিলেন না। তবে শহরের এ টি এম কামাল পাশে থাকলেও ভোটার টানায় তার প্রভাব কম। ভোট টানতে পারেন এমন বিএনপির কোনো নেতা ছিলেন না তৈমূরের পাশে।

চতুর্থ কারণ ওসমান পরিবারের সাহসে তৈমূর প্রার্থী হলেও রূপগঞ্জ এলাকা থেকে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য এতদিন ধরে কাজ করছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়নে তার কোনো ভূমিকা নেই। উৎসবগুলোতে (ঈদ, পূজা ও বড় দিন) একটি অনুদানও এই এলাকায় দেননি। সব মনোযোগ ও ব্যয় রূপগঞ্জকেন্দ্রিক। এটাও পরাজয়ের কারণ। তার ভাই কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে জিতেছে এবার, এটা তার এলাকায় বিনিয়োগের ফল হিসেবে। আর সিদ্ধিরগঞ্জে কাউন্সিলর হয়েছেন বিএনপির সাবেক এমপির ছেলে এবং বন্দরে

এমপি কালামের ছেলেও জিতেছে। ওই কেন্দ্রেও হেরেছেন তৈমূর আলম। অপরদিকে, পার্টটাইমের নেতা তৈমূর আলম বলে মন্তব্য করেছে স্থানীয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সিনিয়র সাংবাদিক সবুজ। তিনি বলেন, রাজনীতি তো করতে হয় পুরো সময়ের জন্য। এটাও পরাজয়ের কারণ।

এদিকে, তৈমূর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণে বিগত দুই সিটি নির্বাচন থেকে এই নির্বাচনটি বিএনপি-জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এমন আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কারণ ওসমান পরিবারের সমর্থন, বিএনপি-জামায়াতের একক প্রার্থী এবং তৈমূর শ্রমিক নেতা হওয়ায় যেই জিতুক ব্যবধান কম হবে এমন ধারণা ছিল সবার। তবে ইভিএমের এই ভোটে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। যদিও তৈমূর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) পরাজয়ের জন্য দায়ী করেছেন। তার অভিযোগ, ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের কারসাজিতে তাকে হারানো হয়েছে। কিন্তু উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটিতে ভোট হয়। ফলও প্রকাশ হয় দ্রুত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইভিএমে ভোট নেওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই প্রযুক্তি চালুর আগে জামিলুর রেজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে যে কারিগরি কমিটি গঠন হয়েছিল ‘নির্ভুল ইভিএম’ না হওয়ায় তিনি এই কমিটির পত্রে স্বাক্ষর করেননি। এমনকি গত ঢাকা সিটি নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা নিজেই ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছিলেন। এমনকি ভারতে ইভিএমে ভোটদানের জন্য তাদের আদালত থেকে পেপার বেইজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তৈমূর আলমকে ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ার করে তাকে হারানো হয়েছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নিরীক্ষার বিষয়।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নাসিক নির্বাচন,নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন,তৈমূর আলম খন্দকার,ভোট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close