বদরুল আলম মজুমদার
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি
আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন!
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঘোষিত সময়ের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। আগের দিন যে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলে ঢুকেছিলেন ফটকের তালা ভেঙে, তারা চলে গেছেন। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল মঙ্গলবারও হলেই অবস্থান করছিলেন। তারা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করলেও হল ছাড়তে নারাজ। আন্দোলনে আছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জোর করে হলে ঢোকাসহ আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও উসকানি আছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি অবশ্যই সম্মান জানাই। তবে মহামারি করোনার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের সরকার যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হয়েছে। এখন সরকার চাচ্ছে, সব শিক্ষক-কর্মচারী এবং আবাসিক ছাত্রের টিকা দেওয়া নিশ্চিত করে হল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পরও কেন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন জানতে চাইলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘একটি চক্র সব কিছুতেই ফায়দা খুঁজতে থাকে। এবারও শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক আবেগকে পুঁজি করে ফায়দা লুটতে চায় প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে আবাসিক হলে অবস্থান করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত সোমবার থেকে দুই দফা চেষ্টা করেও তাদের হলছাড়া করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও হল প্রশাসন। তবে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে আন্দোলন আজ বুধবার পর্যন্ত স্থগিত করার কথা জানানো হয়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হলেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬টি আবাসিক হলের মধ্যে আটটিতেই অবস্থান নিয়েছেন ছাত্ররা। গত শনিবার ছাত্রীদের আটটি হলের তালা ভাঙা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন সেগুলোতে আবার তালা লাগিয়ে দেয়। গত সোমবার দুপুর পৌনে একটার দিকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের ২০-২৫ জন আবাসিক ছাত্রী তালা ভেঙে আবারও হলে ওঠেন। বিকালে প্রক্টরিয়াল টিম ও হলের প্রাধ্যক্ষ সেখানে গিয়ে ছাত্রীদের হল ছেড়ে যেতে অনুরোধ করলেও তারা ছাড়েননি।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে খুলবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়। এর এক সপ্তাহ আগে ১৭ মে খুলে দেওয়া হবে আবাসিক হলগুলো। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ আর অপেক্ষা করতে চাইছেন না। তারা শিগগিরই হলে উঠতে চান। এজন্য গতকালও দিনভর বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্ররা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্ধারিত সময়েই খুলবে হল। এর আগে ১ লাখ ৩০ হাজার আবাসিক ছাত্রছাত্রীকে টিকা দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরাও টিকা পাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সবকিছু যেখানে স্বাভাবিক করা হয়েছে, সেখানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না খোলার কোনো যুক্তি নেই। হলে অবস্থান করার দাবি জানিয়ে যেসব শিক্ষার্থী রাস্তায় নামছেন, এটা তাদের একটি মানবিক দাবি। এদের দাবির সঙ্গে আমাদের শতভাগ সমর্থন আছে।’
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সবকিছু যখন স্বাভাবিক, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে সরকারের আপত্তি কোথায়, এটা নিশ্চয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুঝেন। শিক্ষামন্ত্রী হল ও প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে যে সময় দিয়েছেন, সেটা অনেক বেশি দীর্ঘ। আমরা মনে করি, মধ্য মার্চে বা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
এদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে শাহবাগে কর্মসূচি থাকলেও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। মানববন্ধনের শেষ পর্যায়ে সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ডাক দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের। পরে সেদিকে মিছিল নিয়ে যান তিনি এবং সচিবালয়ের ২ নম্বর গেটের পাশে ১৫ মিনিট সমাবেশ করেন। ওই সময় সচিবালয়ের ২ নম্বর গেট দিয়ে গাড়ি ও দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সমাবেশে নুর বলেন, ‘আজ আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে সচিবালয়ে এসেছি আপনাদের (শিক্ষামন্ত্রীর) কানে ছাত্রসমাজের দাবি পৌঁছে দিতে। কারণ আমরা জানি, আপনারা এসি রুমের মধ্যে থেকে ছাত্রসমাজের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন না। সেজন্য আপনাদের দরজায় এসে কানের দ্বারপ্রান্তে আমাদের দাবিগুলো শুনিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির শেষে কিংবা মার্চের প্রথম দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা চলছিল, সেগুলো চালু করতে হবে। যেহেতু আপনার নির্দেশনায় বন্ধ হয়েছে, সেহেতু আপনি নির্দেশনা দেবেন যে, শিক্ষা কার্যক্রম চলবে।’
ওদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিস্থিতি আছে কি না তা পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সোমবার দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি আরো জানান, আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যেই আন্তমন্ত্রণালয় সভা করে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কমিটির সঙ্গে এ সপ্তাহের মধ্যেই বৈঠকের চিন্তা চলছে। বিশেষ করে কোভিড-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করা হবে। এরপরই স্কুল, কলেজ, মাদরাসা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়না চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী জি কে সাদিক। স্থগিত করা পরীক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করে দেওয়া এবং আগামী ১ মার্চের মধ্যে হল না খুললে হলে উঠে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। দাবি না মেনে নেওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
পিডিএসও/হেলাল