আহমদ বশীর

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পিতৃঋণ

বহুদিন পরে লাট্টুটা বাবুল্যার হাতে দিয়ে ফিরোজ মিয়া বললো, ‘হাঁচা কইতাছি, আঁর বাপে চুরি করে ন’। গেরামের লোকেরা মিছা কথা কয়।’

‘মিছা কথা কয়?’ বাবুল্যা লাট্টুটা হাতে নিয়ে ফিতা প্যাঁচানো শুরু করে। ‘চেয়ারম্যান সাবে যে বাজারত কইছে?’

‘কী কইছে?’

তর বাপেরে পুলিশ ধরছে।

‘পুলিশ ধইরচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বাবায় চুরি করে ন। হ্যাতনরে পুলিশহগল সবাই মান্যগণ্য করে।’

‘তুই কিয়া কস? পুলিশ ধইরলে আবার মান্যগণ্য করেনি? বাবুল্যা ফিতা ধরে লাট্টুটা মাটির ওপর সজোরে নিক্ষেপ করে- আর লাট্টুটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। দূরে ঘুঘু ডাকছিলো কয়েকটা- আর তিতির ঘুরছিলো- কতবেল গাছের নিচে বোল্লার চাক- মৌমাছি ঘুরছে তো ঘুরছেই।’

ফিরোজ মিয়া লাট্টু রেখে কতবেল ভেঙে খাওয়া শুরু করল। তারপর সে বলল, ‘বাবারে কিল্যাই ধইরছে কমু?’

বাবুল্যা হলো ফিরোজ মিয়ার অত্যন্ত কাছের বন্ধু। প্রথম শ্রেণি থেকে এই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ওরা একসঙ্গে চর ইসমাইল ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যায়। বাবুল্যা অবাক বিস্ময়ে ফিরোজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তাইলে তুই ব্যাকেরে জানায়ে দে।’ অর্থাৎ, তাহলে তুই সবাইকে জানিয়ে দে।

ফিরোজ মিয়া হঠাৎ মৃদু মৃদু হাসে আর বলে, ‘অহন না। আমি বড় হইলে ব্যাকেরে খুইল্যা কমু।’

দূরে কোথাও ঘুঘু ডাকছিল। বোল্লার চাকের গুণগুণ শব্দ তাতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করছিল। বাবুল্যা বলে, কবে বড় হইবি আর কখন খুইল্যা কবি? আই যখন দাদার লগে ঢাকায় গেছিলাম তখন হুনছি। পুলিশই কইছে, বাবায় চুরি করে ন, বড় হইলে আমি ব্যাকেরে কইয়া দিমু।

বহুদিন পরে ফিরোজ মিয়া এসব কথা কাউকে বলেছিল?

সেই অনেক দিন আগে কোনো এক মার্চ মাসে চর ইসমাইলের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ফিরোজ মিয়া বসেছিল ক্লাসে। ক্লাসের ছেলেদের প্রায় সবারই খালি গা, হ্যাফপ্যান্ট। জুতো-স্যান্ডেলের বালাই নেই। ফিরোজ মিয়া বসেছিল জানালার ধারে- জানালা দিয়ে নদী দেখা যাচ্ছিল- পাল তোলা নৌকা চলছে তরতর করে। আবার নদীর পাশ দিয়ে গুন টেনে হুমহুম করে কয়েকটা নৌকা চলে গেল।

ইতিহাস স্যার পড়াচ্ছিলেন। ব্রিটিশ রাজারা চলে গেছে। পাকিস্তান কীভাবে স্বাধীন হলো। স্কুলের কালো কুচকুচে ব্ল্যাকবোর্ড দীর্ঘদিন ব্যবহারে তৈলাক্ত হয়ে গেছে। স্যারের চক-পেনসিলের লেখা তেমন পড়া যায় না। স্যার বোর্ডে লিখতে লিখতে বললেন, অন কুন সন চলে কইতি হারবিনি? অর্থাৎ এখন কোন সাল চলছে কেউ বলতে পারবে নাকি?

ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের কাছে উত্তরটা ভীষণ রকমের সোজা। তারা সমস্বরে উত্তর দিয়েছিল, উনিশশ বাহান্ন সাল স্যার।

এই জানুয়ারি মাসেই তো ওরা নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উঠেছে। আর এখন তো ফেব্রুয়ারি মাস।

‘হু’- ঠিক কইছস। ইতিহাস স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন ১৯৫২। ইংরেজিতে বলেন, ‘নাইনটিন ফিফটি টু’। ইতিহাস স্যারের পেছনে স্কুলে বেড়ার ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে রৌদ্রের আলো পড়েছিলো। স্যার এবার সবাইকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করলেন, ‘আইচ্ছা অহন ক, পাকিস্তান কবে স্বাধীন হইছিলো?’

প্রথমে সবাই চুপচাপ বসে থাকে- কেউ কিচ্ছু বলতে পারে না। ফিরোজ মিয়া জানে পাকিস্তান কবে স্বাধীন হয়েছিল- ওর বাবা ঢাকা শহরে যাওয়ার আগে মাকে বলেছিল, পাঁচ বছর হতে চলল পাকিস্তান হইছে- কই পূর্ব পাকিস্তানের কি উন্নতি দেখলাম? গরিব মানুষের চাকরি হয়? চাইলের দাম কমেনি। ফিরোজ মিয়া জানে এখন থেকে পাঁচ বছর আগে হলে পাকিস্তান স্বাধীন হইছে ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ফিরোজ মিয়া খুব মুখচোরা ছেলে। পেটের মধ্যে উত্তর রেডি- কিন্তু সবার সামনে বলতে পারে না।

ক্লাস ফাইভের ফার্স্ট বয় হাবিবুল বলে, ‘উনিশ শ তেইশ, স্যার।’

ইতিহাস স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘দূর ব্যাটা। উনিশ শ তেইশে তোর বাপে জন্ম নিছে। পাকিস্তান ঠিক করি ক।’

কেউ কিচ্ছু বলে না- ক্লাসে একটা নীরবতা। তখন ইতিহাস স্যার আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইয়ানো আংগো নোয়াখালীতে গান্ধীজী আইছিলো জানসনি?’

গান্ধি? গান্ধি পোকা নি কুন? সব ছেলের চাপাস্বরে হেসে ওঠে।

‘ন-ন-গান্ধি পোকা ন। মহাত্মা গান্ধী। নেতা। তাইনে আংগো নোয়াখালী আইছিলো। উনিশ শ ছেচল্লিশ। সেই বছরের পরের বছর পাকিস্তান স্বাধীন হয়। উনিশ শ সাতচল্লিশ।’

স্যার ব্লাকবোর্ডের ওপর আবার লেখেন আর বলেন, ‘১৯৫২ থেকে বিয়োগ করি ১৯৪৭। কত হয়?’

ক্লাসের সবাই আবার সমস্বরে উচ্চারণ করে ‘পাঁচ বছর’।

স্যার ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড পরিষ্কার করে বলেন, ‘অহন ক, পাকিস্তানের জাতির পিতা কে?’

আবার সবাই চুপচাপ। পূর্ব পাকিস্তানের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে সমুদ্রের বাতাস নারিকেল গাছগুলোর পাতা নাড়াচ্ছে, তারা কেউ জানে না পাকিস্তানের জাতির পিতা কে?

‘কইতে হারস না! কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’ স্যার প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন। ‘কায়েদে আযম’ মানে কী?

জানি না স্যার।

ইতিহাস স্যারের পাঞ্জাবির ছেঁড়া পকেট দেখা যায়। স্যার পকেটে হাত দিয়ে রুমালটা খুঁজেন। ‘আংগোর জাতীয় সংগীত জানসনি?’

জানি। পাকসার জামীন সাদবাদ...

ইতিহাস স্যার আবার চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘ন-ন, আই জিগগাইয়ের তোরা এই জাতীয় সংগীতের অর্থ জানসনি?’

‘না, আঁরা জানি ন।’

স্যার ছেঁড়া পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। তিনি বললেন, ‘জানবি কোত্থুন? ইডা উর্দু? না ফার্সি? না আরবি? আঁরা নিজেরাই জানি ন- বুঝি ন। ইয়ান আংগোর বাংলা ভাষা ন। অর্থাৎ এটা আমাদের ভাষা না।’

ফিরোজ মিয়া জানালা দিয়ে দেখল- দূরে একজন সাইকেল চালিয়ে আসছেন স্কুলের দিকে। সে ভালো করে থাকিয়ে দেখল, অঙ্ক স্যার না! কিন্তু এখন তো স্যারের আসার কথা না। উনি তো সকালবেলা খেতে হালচাষ করেন গরু নিয়ে। দুপুরের আগে স্কুলে আসার কথা নয়। স্যার যখন স্কুলের কাছে চলে এলেন, তখন দেখা গেল তার চোখে-মুখে কী রকম একটা চিন্তা খেলা করছে।

ইতিহাস স্যার তখনো বলছিলেন, ‘জাতীয় সংগীত বোঝার দরকার কী? আমরা গাঁও-গেরামের লোক আমাদের কি জাতীয় সংগীতের অর্থ বোঝার প্রয়োজন আছে! পশ্চিম পাকিস্তানের লোকরাই এই দেশ শাসন করে। ওরা বুঝলেই তো হয়।’

ফিরোজ মিয়া মনে হয় সে এখনই প্রশ্ন করে, ‘স্যার বাংলার কি দরকার নাই?’ কিন্তু ফিরোজ মিয়া এই প্রশ্ন করতে পারে না, ঠিক সেই সময় অঙ্ক স্যার এসে ঢুকে পড়েন ক্লাসে।

ইতিহাস স্যার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে। কী ব্যাপার? তুমি এখানে?

অঙ্ক স্যার তখন ইতিহাস স্যারকে ডেকে নিয়ে যান। বাইরে ওরা কী সব বলাবলি করেন। আর একটু পরই ইতিহাস স্যার ক্লাসের ভেতরে ঢুকেই ডাকেন, ‘ফিরোজ মিয়া। ইয়ান আইও’ এদিকে এসো।

ক্লাসের সবাই তখন অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ফিরোজ মিয়ার দিকে, এই ছেলেটার হলোটা কী? অঙ্ক স্যার ডাকছে কেন? বাবুল্যা সেদিনও তার পাশে বসে ছিল। ফিরোজ মিয়া কিছু বুঝতে পারছে না দেখে সে বলল,‘তরে যে অঙ্ক স্যার বুলায়’। সে কথা শুনে ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়- তার আদুরে গা ঘেমে গেছে। ভয়ে কাঁপছে সে।

অঙ্ক স্যার বললেন, ‘আয়। আমার সঙ্গে চল। তোদের বাড়িতে যাবো।’

আংগো বাড়ি? ফিরোজ আশ্চার্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করে। সে জানে অঙ্ক স্যার তার বাবার বন্ধু। তাই সে বলল, ‘আর বাবায় তো বাড়ি থাহে ন। হিগা ঢাকায় চলি গেছে।’

অঙ্ক স্যার বলেন, ‘হেইডা আঁই জানি অই। অহন তুই আঁর লগে চল। আঁই তর দাদার লগে কথা কমু।’

ফিরোজ মিয়া এবার অঙ্ক স্যারের পিছু পিছু রওনা হয়। ইতিহাস স্যার আবার ক্লাসে ঢুকে পড়েন। অঙ্ক স্যার ফিরোজ মিয়াকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে এক লাফে সিটের ওপর বসে পড়েন। তারপর বলেন, ‘ফিরোজ মিয়া, অহন বাড়িত যাই তুই তোর দাদারে ডাকি আনবি অতি তাতাই। তোর দাদার লগে বহুত দরকারি কথা কমু আমি।’

ফিরোজ মিয়া মাথা নাড়ায়। সে এখনই দাদাকে ডেকে আনবে। তার একবার ইচ্ছে হলো এটু জানা দরকার- এত্তো সকালে তার দাদার সঙ্গে কী জরুরি কথা থাকতে পারে অঙ্ক স্যারের।

গ্রামের জঙ্গলময় রাস্তা দিয়ে ওরা যখন বাসায় পৌঁছাল তখন দাদা ভাই নদী থেকে মাছ ধরে এসেছে। তার কাঁধে ঝাঁকি জাল- হাতে খালোই। খালোই ভর্তি মাছ লাফালাফি করছে। দাদার সারা শরীর বেয়ে নদীর কাদা আর পানি চুইয়ে পড়ছে।

অঙ্ক স্যার দাদাকে দেখে সালাম দিলেন। ‘চাচা, আসসালামু আলাইকুম’।

দাদার মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি- সেখান থেকে শব্দ বেরোলো, ‘ওয়ালেকুম আসসালাম। বাজান এত্তো ভেইন্না ভেইন্না বেলা কিল্লাই আইছো!’

সাইকেলটা ফিরোজ মিয়ার হাতে দিয়ে অঙ্ক স্যার দাদার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ‘চাচা আঁন্নেরে একটা কথা কইবারলাই আইছিলাম’।

‘কি কতা বাজান। ঘরের ভিতরে আইও’... দাদা হাত দিয়ে তার দাড়ি থেকে নদীর পানি মুছতে মুছতে বললেন।

‘চাচা, ফিরোজের বাপের একখান খবর আছে। সংবাদটা ঢাকাত্থুন আইছে।’

‘কি সংবাদ, বাজান?’

‘সংবাদটা দিলো আংগো তহশিলদার। সকালে আমি বাজারে যাই তার লগে দেখা হয়। হ্যাতে বলে দারোগা সাহেব নাকি হিগারে এই সংবাদ কইছে’।

অঙ্ক স্যার যেন কিচ্ছু বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘সামেদকে নাকি পুলিশ ধরছে। আংগোর থানার দারোগাত্থুন তহশিলদার জাইনছে’।

দাদার হাত থেকে মাছের খালোই পড়ে যায়। ‘হায়! হায়! আর পুতরে পুলিশ কিল্লাই ধইরচ্ছে! আর পুতে কিছু করে ন। না-না, কিচ্ছু করে ন।’

অঙ্ক স্যার বললেন, ‘চাচাজান কান্দিয়েন না। অহন আঁগে দারোগা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আর দারোগা সাহেবকে ধইরতে হইলে চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করা দরকার।’

দাদার রোনাজারি শুনে নারিকেলের পাতা দিয়ে ঘেরা পাকঘর থেকে মা চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘হায় হায় ওমা, আব্বা আন্নে কিয়া কন, আংগো ফিরোজের বাপরে, পুলিশ... ধইরচ্ছে।’

মায়ের কান্নার শব্দে কিছুক্ষণের মধ্যে আশপাশ থেকে প্রতিবেশীরা ছুটে এলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারা গ্রাম জেনে ফেলল, ফিরোজের বাবাকে পুলিশ ধরেছে ঢাকায়। সবাই প্রশ্ন করল, হ্যাতেরে পুলিশ ধইরলো কিল্লাই? হ্যাতে কি চুরি কইচ্ছে নি কুন? কিছু একটা আকাম না কইরলে পুলিশ ধরেনি!

অঙ্ক স্যারের দিকে তাকিয়ে দাদাজান তখন অঝোরে কাঁদছে আর বলছে, ‘শামসুগো সামেদ তো তোমার দুস্ত আছিলো, তুমি তো জান সামেদ চুরি করতে পারে ন। খুন করে ন। হ্যাতেরে আই কতবার করি নিষেধ করি- ঢাকা যাইছ না। হ্যাতে আমার কথা শুনে ন। আঁরা নদীর কুইল্লা মানুষ, আঁরা মাছ ধরি খাইয়ুম। হ্যাতে আঁর কথা না শুনি ঢাকা যাই থাহে, অহন আই কি করুম?’

অঙ্ক স্যার শুধু বললেন, ‘চাচাজান অহন চলেন, আঁরা চেয়ারম্যান সাহেবরে জানাই। হ্যাতেন দারোগারে কইলে হিগায় ছাড়া পাইবো।’

দাদাজান কাঁধ থেকে মাছ মারার জালটা ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। কপালের চুলগুলো সরিয়ে বলে, ‘আই জানি চেয়ারম্যান সাহেব সামেদের লাই কিচ্ছুু কইত্ত ন। সামেদ হ্যাতের নির্বাচনে সাপোর্ট করে ন। চেয়ারম্যান সাব আংগো দূর দূর করি খেদাই দিবো।’

অঙ্ক স্যার তবু আশা ছাড়েন না। বলেন, ‘চাচাজান, আন্নে যাই কন, চেয়ারম্যান সাবরে না কইলে দারোগা সাহেবের কাছে যাওন যাইতো ন। আনড্ডা আগে হ্যাতের লগে দেখা করি।’

রাতে ওরা সবাই চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল। ফিরোজ মিয়া, দাদাজান, অঙ্ক স্যার। আর ফিরোজ মিয়ার মা একটা কালো কাপড় মাথায় দিয়ে ওদের সঙ্গে রওনা হলো।

চেয়ারম্যান সাহেব মাথায় টুপি পড়ে হুঁকা খেতে খেতে দহলিজে এসে বসলেন। তার সাদা পাঞ্জাবির ভেতর থেকে লোমশ দুটো হাত বেরিয়ে এসেছিল। ঘরে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছিল। তীব্র আলোতে দহলিজের কালো কালো মাকড়সার ঝুল- আর পাকিস্তানের জীর্ণ একটা ছেঁড়া পতাকা আত্মপ্রকাশ করেছিল। একটা কালো কাঠের সিংহাসনের মতন চেয়ারে বসেছিলেন চেয়ারম্যান- তার দুই হাতায় দুটো সিংহের মুখ হাঁ- করে আছে।

চেয়ারম্যান হুঁকোর নল মুখে দিয়ে ধোঁয়া টানছিলেন- দূরে পেতলের হুঁকোতে গুরর গুরর শব্দ হচ্ছিল। প্রথমে অঙ্ক স্যার সব বৃত্তান্ত খুলে বললেন- সামেদকে পুলিশ আটক করেছে- দারোগা সাহেব নিজেই এই কথা বলেছে তহশিলদার নগেনকাকাকে। নগেনকাকা দারোগা সাহেবকে বলেছে যে, সামেদের বাড়িঘর; সে চেনে। দারোগা সাহেব তাই সামেদের বাবাকে ঢাকায় যেতে বলেছে। ছেলেকে যদি ফেরত নিতে হয় তবে সামেদের বাবা যেন টাকাপয়সা নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় পুলিশের বড়কর্তা আছে- তাকে গিয়ে বললেই কিছু সুরাহা হতে পারে।

চেয়ারম্যান হুঁকোর নল মুখ থেকে নামিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, তোরা আইছিস, তগো কথা হুনছি। কিন্তু সামেদের এই অবস্থা যে হইবই তা আগেই জানতাম। হ্যাতে যখন ইলেকশনে আমার পক্ষে কাজ করে ন- তখনই আমি জানতাম ওর পতন হইবেই। কি আমি কই-ন?

সবাই একবাক্যে বলে, ‘হুজুর আন্নে ঠিকই কইছিলেন।’

চেয়ারম্যান সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘তয়? এখন তো তার উচিত শিক্ষাই হইছে। ওখন ঢাকা শহরে গিয়ে কাজ-কাম পায় ন। তাই চুরি-চোট্টামি করি বাঁইচতো চায়। ঠিক নি?’

চেয়ারম্যানের কয়েকজন সহযোগী তখন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ঠিক কইছেন হুজুর। আন্নে সকল সময়ই সঠিক কথা কন।’

চেয়ারম্যান এবার বললেন, ‘তা সামেদ চুরি করি, মানুষ খুন করি, আমগো মান-ইজ্জত ডুবাই দিছে। ইটা শুধু আমাগো না চর ইসমাইলের লোকহগলের লজ্জা। আংগোর সমাজে মুখ দেহানোর সুযোগ নাই। ছি: ছি: ছি:?’

হুজুরের কথা শোনা মাত্রই তার পারিষদ বলে উঠল, ‘ছি: ছি: ছি: সামেদ পারে না এমন কোনো খারাপ কাজ আর নাই।’

চেয়ারম্যানের একজন কর্মচারী এসে তার পেছনের হুঁকোর ওপরে আরেকটা তামুক রেখে গেল। চেয়ারম্যান হুঁকোর নল টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে টান দিলেন, সবাই একসঙ্গে নিঃশব্দ হয়ে গেল- তখন শুধু পিতলের হুঁকোর ভেতর গুরুম গুরুম শব্দ।

কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান চোখ খুললেন। তারপর অঙ্ক স্যারের দিকে ইঙ্গিত করে কাছে আসতে বললেন। অঙ্ক স্যার তার কাছে গিয়ে বসলে তিনি শুরু করলেন, ‘হোন মিয়ারা, দ্যাশের অবস্থা অহন বালা ন। পাকিস্তানের ময়মুরব্বি অহন কেউই বাঁইচ্চা নাই। কায়েদে আজম মইরা গ্যাছে। লিয়াকত আলীকে গুল্লি কইরা মারছে, শেরে বাংলা পালায়া বেড়ায়, আর কিছু বোঝ?’

অঙ্ক স্যার মাথানত করে বলে, ‘জি বলেন, হুজুর।’

‘কইতাম চাই যে দ্যাশে ইন্ডিয়ান এজেন্ট ভইরা গেছে। এই নোয়াখালীতে গান্ধী আইছিলো না? হ্যাতে এ্যাহানো এজেন্ট রাইখ্যা গেছে। হ্যাতেরা এই দ্যাশরে হিন্দুগো দ্যাশ বানাইতো চায়। তোমরা হুনছনি ঢাকায় ছাত্রগুলারে ক্ষ্যাপাইয়া দিয়া কয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা মাইনে বুঝছনি? রাষ্ট্রভাষা বাংলা করলে হিন্দুগো লাভ। হ্যাতেরা বাংলা কইবো?

কে একজন সাগরেদ প্রশ্ন করে, ‘হুজুর বাংলা হইলে ক্ষতি কি?’

চেয়ারম্যানএকটা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘বাংলা ভাষা মুসলমানের ভাষা নি? মুসলমানের ভাষা আরবি- ফারসি- আর উর্দু।’

হ্যাজাকের বাতির আলো গনগন করে জ্বলছিল। তার আলোতে চেয়ারম্যানের মুখটা অদ্ভুত দেখাল। ‘আর আংগোর সামেদ হেই এজেন্টগো হাল্লায় হরি চুরি-চামারি করে। ছি: ছি: ছি: মানুষ খুনও করবার পারে।’ সামেদের মতো লোকের পক্ষে সবকিছু সম্ভব।

কেউ কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ। অঙ্ক স্যার হঠাৎ দুই হাত এক সাথে এনে মাথানত করে বলে, ‘হুজুর, আন্নের দিল দয়ার সাগরের লাহান। আন্নে হ্যাতেরে মাফ করি দ্যান। হ্যাতে ইবার আন্নের ইলেকশনে কাম করবো।’

চেয়ারম্যান হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘জ্বাউল্যার বাইচ্চা জাউল্লা হইবো। সামেদের বাপ কই? ওই সামেদের বাপ, তুমি জাউল্যা ন? তুয়ার পোলা জাউল্যাগিরি ছাড়ি পলিটিক্স করে ক্যান?’

সামেদের বাপ কিছু বলার আগেই অঙ্ক স্যার আরো বিনীত কণ্ঠে বল্লেন, ‘হুজুর, আপনের দয়ার শরীল। আন্নে হ্যাতেনরে মাফ করি দেন।’

চেয়ারম্যান হঠাৎ ফিরোজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ল্যাংটা বাইচ্চা ক্যাডা? সামেদের ছাও? ফিরোজ মিয়া হুঙ্কার শুনে অঙ্ক স্যারের পিছনে লুকাতে চায়।

চেয়ারম্যান বলে, ‘এইডা আরেকটা চোর হইবো। দ্যাখছস অর চোখ ক্যামনে জ্বলে। চোরের বেটা চোর।’

অঙ্ক স্যার আবারও বলে, ‘হুজুর’।

চেয়ারম্যান এবার একটু সময় নেয়। তারপর বলে, ‘তা আরে কি করতে কও তোমরা? আই কিত্তাম?’

অঙ্ক স্যার বলে, ‘আন্নে একটু দারোগা স্যাররে কই দ্যান। হ্যাতে আংগো ঢাকায় পাঠাতি চায়। সামেদের মুক্ত করনের লাই...’

চেয়ারম্যান মাথার টুপি খুলে পায়ের ওপর রাখলেন। পাকিস্তানে অহন ভাষার লাই মারামারি চলে। দ্যাশের পরিস্থিতি খুব খারাপ, অহন পুলিশের লগে কথা কওন যায় না।

এ সময় সামেদের বাবা ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘হুজুর আর পুতেরে মাফ করি দ্যান, হ্যাতে আন্নের গোলামি কইরবো, হারা জীবন। দারোগা সাবরে একটু বলি দ্যান। আনড্ডা আন্নের পায়ে ধরি।’

শেষ রাতের দিকে চেয়ারম্যান সাহেবের মন গলে, তিনি সামেদের বাবার কাছ থেকে পা সরিয়ে নেন, তারপর সবাইকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ও মিয়ারা হোনেন- কোনো চোরের লাই আই পুলিশের লগে কথা কইতাম চাই না। শুধু সামেদের বাপের রোনাজারি আই সহ্য করতাম হারি ন। আঁর মন গলি যায়। কাইলকাই আঁই দারোগারে কই দিমু। তোমরা ঢাকায় যাও। দেহি আল্লায় কি করে!’

এরপর চেয়ারম্যান দহলিজ থেকে ভেতর বাড়িতে চলে যায়। আর সবাই যার যার বাড়িতে ফিরতে থাকে। ফিরোজ মিয়ার স্পষ্ট মনে আছে সবাই বলাবলি করতে থাকে- সামেদ একটা বোকা- সে কিল্লাই ইন্ডিয়ান এজেন্ট গো লগে খাতির করে? সে চুরি কইরা গ্রামের সকলের মানসম্মান ডুবিয়েছে। এখন আঁর এই গ্রামের মানুষের সম্মান বলে কিছুই থাকলো না। কে যেন একজন পাশের থেকে বলে ইন্ডিয়ান এজেন্ট দিখতে কেমুন? তারা হোলা না মাইয়া?

সোনাপুর বাজারের শেষ প্রান্তে পুলিশ ফাঁড়ি। খাকি রঙের হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ প্রহরী বসেছিল ফাঁড়ির সামনে তেঁতুলগাছের তলায়। তার পায়ের কাছে বসে থাকা নিরীহ কুকুরটা ওদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠে দাঁড়াল। ফিরোজ মিয়া অঙ্ক স্যারের হাত ধরে হাঁটছিল- তাদের পেছনে মা একটা বোরকা পরে হাতে গামছায় বেঁধে নিয়েছে কিছু আটার রুটি আর লাউ-তরকারি। তার পেছনে দাদা একটা ফতুয়া পরেছে দুই পকেটওয়ালা।

পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে ঢুকতেই দারোগা সাহেবকে দেখা গেল। লম্বা একটা আরাম কেদারায় তিনি প্রায় আধশোয়া অবস্থায় পত্রিকা পড়ছিলেন। প্রহরী এসে তাকে জানাল, চর ইসমাইল থেইক্যা কয়জন মানুষ আসিছে।

দারোগা সাহেব পত্রিকা ভাঁজ করে রাখলেন পাশের টেবিলে, তারপর কয়েক মিনিট চুপচাপ ওদের দেখলেন। তিনি কিছু বলার আগেই দাদা কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, ‘স্যার আঁর পোলারে ঢাকায় পুলিশে ধইরচে, আই কিয়া করুম জানি ন। আংগোর চেয়ারম্যান সাব কইয়ের...’

দারোগা সাহেব তার কথা যেন শুনতেই পাননি- এভাবে অবজ্ঞা করে কাকে যেন ডাক দিলেন। একজন পুলিশ ঘরে ঢুকলে দারোগা সাহেব তাকে প্রশ্ন করতে বললেন।

পুলিশ বলল, তোমরা কারা? কীজন্য এসেছো?

অঙ্ক স্যার বললেন, ‘আমরা চর ইসমাইল থেকে এসেছি। উনার ছেলের নাম সামেদ। সামেদ আলী। তাকে নাকি ঢাকায় পুলিশ ধরছে...’

দারোগা সাহেব বললেন, ওহহো তোমরা সেই সামেদ আলীর জন্য এসেছো? তোমাদের চেয়ারম্যান আমাকে বলেছে,

হ, স্যার হ।

শোনো, ওই লোকটাকে নাকি ঢাকায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

স্যার, ওকে কি জন্য গ্রেপ্তার করেছে স্যার?

দারোগা সাহেব একটা ফাইল খুলে দেখলেন, তারপর বললেন, ‘কি জন্য গ্রেপ্তার করেছে বলা যাচ্ছে না। ওকে ধরেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। এখন কি মাস? এপ্রিল? তো প্রায় দেড়-দুই মাস আগে। ঢাকা থেকে যে চিঠি এসেছে সেখানে লেখা আছে ফেব্রুয়ারি মাসে ওকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

‘স্যার অহন কী করুম?’

‘দেখো, এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনেক গ-গোল হয়েছে। কয়েকজনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তোমাদের গ্রাম চর ইসমাইল ঢাকা থেকে অনেক দূরে, তাই তোমরা কোনো খবর পাও নাই। পুলিশ ঢাকায় তোমাদের এই নোয়াখালীর সালাম নামে একজনকে গুলি করে মেরেছে ২১ তারিখে। দাগনভূঁইয়া বাড়ি ওর। ওই যে ওর লাশের ছবি।’

কিছুক্ষণ থেমে দারোগা বলল, ‘তা তোমাদের ওই সামেদ আলী লোকটা কী করত?’

‘কিছু করত না, স্যার। চাকরি করনের লাই ঢাকায় গেছিল’, অঙ্ক স্যার বলল।

দারোগা সাহেব ফাইলটি ছুড়ে ফেলে দিলেন টেবিলের ওপর। ‘যদি চারশ বিশ ধারা হয় তাহলে প্রতারণা, যদি তিনশো বিশ, তাহলে খুন। দেখো ঢাকায় গিয়ে যোগাযোগ করো।’

দাদাজান তখনো কাঁদছে আর বলছে, ‘আঁর পুতে চুরি করে ন। হেতে পড়ালেখা করে...’

দারোগা সাহেব বললেন, ‘আপনারা ঢাকায় যান। ডিআইজি প্রিজনের সাথে দেখা করেন। তিনি আপনাদের সঠিক খবর দিতে পারবেন। আপনার ছেলে একটা অপরাধ না করলে কি আর পুলিশ ওকে ধরেছে। সে নিশ্চয়ই অপরাধী।’

‘স্যার, ওই যে বললেন, দাগনভূঁইয়ার সালামকে গুলি করে মারছে। ওর কী অপরাধ ছিল?’

‘সরকার যেটা করতে নিষেধ করবে, সেটা করাই পুলিশের চোখে অপরাধ। শোনো, অপরাধ না করলে পুলিশ তো আর গুলি করত না। সে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করেছে।’

অঙ্ক স্যার বললেন, ‘আচ্ছা স্যার আপনার দোয়া লইয়া যাই আমরা। আমরা আইজই ঢাকা যামু।’

‘আগে কখনো ঢাকা গেছো।’

‘না।’

‘তাহলে শোনো, সোনাপুর থেকে সুধারাম গরুর গাড়ি করে চলে যাও। তারপর সুধারাম থেকে ট্রেনে যাবে লাকসাম। লাকশাম থেকে বাসে চাঁদপুর। চাঁদপুর থেকে লঞ্চে করে ঢাকার সদরঘাটে নামবে। সেখান থেকে রিকশায় যাবে উর্দু রোড। আর সেখানেই বড় জেলখানা। যাও, ওখানে দেখা করবে ডিআইজি প্রিজনের সাথে।’

আগামীকাল সকালেই ওরা ঢাকায় রওনা হবে। হযরত আলীর গরুর গাড়ি আগের দিন বিকেল থেকেই ফিরোজদের বাড়ির পাশে এনে রাখা হলো। গ্রামের লোকজন ওদের বাড়িতে তখন ভিড় করে আছে। সবাই শুধু বলছিল কি লজ্জার কথা! সামেদকে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হলো।

কেউ বলতে পারছে না সামেদ কী চুরি করেছে, না মানুষ খুন করেছে? কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব তো জানে বলেই বলছেন সামেদকে চুরির অপরাধে ধরতে পারে, খুনের অপরাধেও ধরতে পারে। আর সামেদের মতো মানুষের পক্ষে সবই করা সম্ভব। সামেদ জাউল্যার পোলা। কিন্তু সে মাছ ধরেনি। বরং কী কাজ করার জন্য ঢাকা শহরে গেছিল কেউ জানে না।

দাগনভূঁইয়ার আবদুস সালাম নামের লোকটাকে তো পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। তাও তো ফেব্রুয়ারি মাসে। কী কারণে কেউ জানে না। ঢাকায় কী হচ্ছে, সে খবর চর ইসমাইলে আসবে কীভাবে!

রাতে ফিরোজদের বাসায় এলো বাবুল্যা, ‘ফিরেজ্যা, তরা নাকি সুধারাম যাইবি, গরুর গাড়ি আইনত হিয়ানো যাওনের লাই?’

ফিরোজ মিয়া বলল, ‘আরা শুধু সুধারাম ন, আরা সুধারাম যাই আবার লাকসাম যামু, লাকসামথন নদীর ওপারর ইস্টিমার।’

‘ইস্টিমার করি কই যাইবি?’

‘ইস্টিমার করি আরা ঢাকা যাইয়ের।’

‘ক্যান?’

‘আঁর বাপরে পুলিশে ধইরচ্ছে। আঁরা পুলিশথন হ্যাতেনরে লই আইমু।’

‘তর বাপেরে কিল্লাই পুলিশ ধইরচে?’

‘অঙ্ক স্যারে কয়, আঁর বাপ কুন দুষ করে ন। হ্যাতেনরে পুলিশ ভুল কইরা ধইরচে।’

শেষ দৃশ্যটা ফিরোজ মিয়ার পরিষ্কার মনে আছে। তখন সকাল ১১টার মতো হবে। ফিরোজ মিয়া ছিট কাপড়ের শার্ট পরেছিল। ওর খাকি রঙের ছেঁড়া হাফপ্যান্টটা বারবার খুলে পড়ে যায়। তাই একটা রশি দিয়ে কোমরে বেঁধে নিয়েছিল সে। মা ছিল কালো বোরকার ভেতর ঢাকা। অঙ্ক স্যার একটা পাঞ্জাবি পরেছিল- ইস্টিমারের ডেকে বসে থেকে চাপচাপ ময়লা লেগে গেছে। আর দাদাজানের ফতুয়াটার পকেট ছেঁড়া- ঘামের মানচিত্র তার পিঠে।

ফিরোজ মিয়া দেখল ডিআইজি প্রিজনের অফিসে যেন দরজা নেই। দুদিকে লাগানো অর্ধেক দরজা লোকজন ভেতরে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। অফিসের সামনে কয়েকজন প্রহরী। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। কেউই ওদের কথা শুনতে চায় না। অঙ্ক স্যার অনেকবার চেষ্টা করেছিল, ওদের একটু কাছে গিয়ে কথা বলতে। সবাই ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অহন কোনো দেখাদেখি করন যাইব না। আভি কোয়ি বাত হোগা নাহি। অফিসাররা ব্যস্ত আছে।

অঙ্ক স্যার ব্যর্থ হচ্ছিল দেখে ফিরোজ মিয়া মনে মনে খুব হাসছিল। ক্লাসে পড়ানোর সময় অঙ্ক স্যারকে কী বীরের মতো দেখায়। তখন অঙ্ক স্যার বেত হাতে একে মারে; ওকে মারে। আজ অঙ্ক স্যার কয়েকজন দারোয়ান পুলিশের কাছে বকাবকি খাচ্ছে।

এই অবস্থা শেষে দাদাজান আর সহ্য করতে পারল না। সে দৌড়ে গেল এক সশস্ত্র পুলিশের কাছে। তারপর রাগে-দুঃখে টান দিয়ে নিজের ফুতুয়াটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আঁরা অহনই অফিসারের লগে দেখা করতাম চাই। আর পুতরে হ্যাতে বন্দি কইরা রাখছে। আঁর পুত...’

বন্দুকওয়ালা পুলিশটা বন্দুক তাক করে ধরে দাদাজানের দিকে। ‘হ্যান্ডস আপ’ অখখনই তোরে গুলি করুম?

দাদাজান চিৎকার দিয়ে বলে, ‘আঁরে তোরা গুলি করি মারি ফেল। আঁর পুতরে তরা আটকি রাখ?’

‘কে তোর পোলা?’

‘আঁর পুতের নাম সামেদ। হ্যাতে চুরি করে ন। খুনখারাবি করে ন। হ্যাতে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে। হ্যাতের সুরা পাঠ করি শুনলে মসজিদে লোক জমা হই যায়। হ্যাতে চুরি করে ন। হ্যাতে শুধু বই পড়ে। বই পড়ি হ্যাতের মাথা খারাপ হই গেছে।’

শান্ত্রি¿ এসে এবার দাদাজানের ফতুয়া চেপে ধরে। আরেকজন শান্ত্রি¿ দাদাজানকে প্রহার করতে থাকে। ‘আল্লায় তোগো বিচার করব। আঁর পুতে চুরি করে ন। খুন করে ন।’ বলতে থাকেন দাদা।

ঠিক সেই সময় একটা জলপাই রঙের উইলস জিপ এসে দাঁড়াল অফিসের সামনে। জিপ থেকে কয়েকজন পুলিশ নামল লাফ দিয়ে। তারপর একজন মোটাসোটা অফিসার নামলেন, পুলিশগুলো দুপাশে হেঁটে হেঁটে তাকে অফিসের দরজার কাছে নিয়ে এলো। তিনি হঠাৎ দাদাজানের চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর পাশের পুলিশদের জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

পুলিশরা বলল, ‘এই লোকটা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওর ছেলেকে নাকি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।’

দাদাজান তখনো চিৎকার করে বলছে, ‘আঁর পুতে চুরি করে ন।’

অফিসার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলের নাম কী?

‘সামেদ। সামেদ আলী।’

অফিসার বললেন, ভেতরে আসুন।

ওরা তখন ভেতরে ঢুকল, অফিসার তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তারপর আর্দালীকে ডেকে কাগজপত্র আনালেন। কয়েক মিনিট চুপচাপ কাগজপত্রগুলো পড়তে থাকলেন।

সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরে পিনপতন নীরবতা, মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান ঘুন ঘুন করে ঘুরছে। শুধু সেই ঘূর্ণি বাতাসের শব্দ হচ্ছিল ঘরে।

অফিসার কাগজপত্র থেকে মাথা উঁচু করে তাকালেন, আপনার ছেলের নাম সামেদ?

‘জি অ।’

‘শোনেন আপনার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে। ওইদিন ও ওখানে কি করছিল জানেন?’

‘না হুজুর। হ্যাতে যাই করুক চুরি করে ন, ডাকাতি করে ন, মানুষ মারে ন?’

অফিসার বললেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। সামেদ চুরি করে নাই, ডাকাতিও করে নাই। চুরি করছি আমরা, ডাকাতি করছি আমরাই। আমরাই আসল চোর।’

সবাই চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। পুলিশ অফিসার কি বলছে? পুলিশ অফিসার তখন বলছিলেন, ‘সামেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে। সেদিন মেডিকেল কলেজের সামনে ওরা বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই করছিল। সত্যি কথা হলো পাকিস্তান সরকার এ দেশ থেকে বাংলা ভাষা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা পাকিস্তানের পুলিশ, সরকারের কেনা গোলাম। তাই আমরাই চোর। আর সামেদ সেই চুরি বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ করেছে।’

দাদাজান পুলিশ অফিসারের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ‘আন্নে কিয়া কন? আঁর পুতে চুরি করে ন।’

‘না, সামেদ চুরি করে নাই। সত্যি বলছি বরং আপনার ছেলে চোরদের ধরতে চেয়েছে। যারা বাংলা ভাষা চুরি করছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। ... আমরা যা পারিনি...’

দাদাজান বলল, আঁরা কিত্তাম?’ ... অর্থাৎ আমরা এখন কী করব?

পুলিশ অফিসারের ভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘শোনেন, আপনারা একটা অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে যান। ওর পক্ষে আমরা মামলা করার জন্য উকিল দেব। হয়তো ওকে আরো অনেক দিন জেলখানায় থাকতে হবে। এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না।’

পুলিশ অফিসার কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর আবার বললেন, ‘আপনারা নোয়াখালী থেকে এসেছেন? নোয়াখালীর দাগনভূঁইয়ার আরেকজন, কী নাম যেন? ও মনে পড়েছে, আবদুস সালাম, সে তো জীবনই দিয়ে দিল ভাষার জন্য।...’

কালো বোরকার ভেতর মায়ের চোখ দুটো দেখা যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কী কথা বলে কেউ বোঝে না। তখন ফিরোজ মিয়া এক হাতে মায়ের হাত ধরে, অন্য হাতে হাফপ্যান্টের দড়িটা ঠিক করছিল। পুলিশ অফিসার ওর দিকে তাকালেন। ‘এই ছেলেটা কে? আপাদের সাথে এসেছে?’

অঙ্ক স্যার বললেন, ‘স্যার এটা সামেদের ছেলে। ওর দাদাজানের সাথে আইছে।’

পুলিশ অফিসার ডাকলেন, ‘এই ছেলে, এদিকে এসো। কী নাম তোমার?’

ফিরোজ মিয়া ভয়ে কাঁপছিল। অঙ্ক স্যার বললেন, যা স্যারের কাছে যা। স্যার না তরে ডাকে!’

ফিরোজ মিয়া পায়ে পায়ে পুলিশ অফিসারের কাছে দাঁড়াল। তিনি ফিরোজ মিয়ার কাঁধে হাত রাখলেন। ‘তুমি সামেদের ছেলে। সামেদ ছাড়া পাবে কি না জানি না। তোমাকে বলে যাই, তুমি বড় হলে দেশের সবাইকে জানিয়ে দিয়ো, তোমার বাবা বাংলা ভাষার চোরদের ধরতে চেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। ... যা অনেকেই পারেনি...’

কিছুদিন পরে বাবুল্যার সঙ্গে লাট্টু খেলতে খেলতে ফিরোজ মিয়া বলছিল, ‘আঁর বাপে চুরি করে ন, পুলিশের বড় অফিসার কী কইছে জানসনি?’

বাবুল্যা লাট্টু থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী কইছে? তাইলে তোর বাপরে জেলখানায় রাখছে কিল্লাই?’

‘এই দেশে নাকি বাংলা ভাষা চুরি হইতে লাগছিল। আঁর বাপে বাংলা ভাষা চুরি হইতে দেয় ন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close