নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

নিউজ করে আমার কেউ কিছু করতে পারবে না: প্রতিবেদকের কাছে ভূমি কর্মকর্তার বড়াই

ঘুষে কোটিপতি ভূমি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম

ঘুষ বাণিজ্যে কোটিপতি ভূমি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিস অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। খতিয়ান, দাগ নম্বর, নামজারিসহ ভূমির যেকোনো কাজে ঘুষ বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিলেন তৎকালীন ইউপি ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আব্দুস সালাম। শাস্তি হিসেবে দু-দফা বদলির পর বর্তমানে তার জায়গা হয়েছে শিবচর উপজেলার মাদবরের চর ইউনিয়নে। শুধু তাই নয়, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী তহশিলদার হিসেবে পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে বদলি ও পদোন্নতি সত্ত্বেও ঘুষ বাণিজ্য ছাড়েননি ভূমি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজ উপজেলার কুলপদ্দি এলাকায় করেছেন অর্ধকোটি টাকার বাড়ি। রয়েছে নামে বেনামে সম্পত্তি।

মাদারীপুরের বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় থেকে শুরু করে নামজারি ও দেওয়ানি ব্যক্তি মালিকানা মামলার প্রতিবেদন ও ভূমি সংক্রান্ত প্রতিটা কাজে ঘুষ নেওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বদলির আগে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেননি বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী। ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করার জন্য অনলাইনে আবেদন করলে ভূমি কর্মকর্তা আবেদন বাতিল করে, পরে ঘুষ নিয়ে তালিকাভুক্তি করেন বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

সূত্র বলছে, বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রতিটা নামজারির জন্য ৮ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন আব্দুস সালাম। কিন্ত প্রতিটা নামজারির জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি মাত্র ১১৭০ টাকা। জনসাধারণ নিজে অনলাইনে নামজারির জন্য আবেদন করলে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দেন তিনি, যাতে ঘুষ খাওয়া যায়।

ভুক্তভোগীরা জানান, ভূমি কর্মকর্তা আব্দুস সালাম খতিয়ানের কপি তুলতেই মোটা অংকের বিল ধরিয়ে দেন। ভূমি উন্নয়ন করের অর্ধেক টাকা দিলেই কাজ করে দেন। যারা ঘুষ দেন না, তাদের ঝামেলা তৈরি করেন। ‘সরকারের কোষাগারে আমি যত টাকা জমা করি এ নিয়ে কোনো আপত্তি করতে পারবেন না এবং কাউকে জানাতে পারবেন না। জানালে জেল হতে পারে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। যদি তার কথায় রাজি থাকেন, তবেই কাজ করে দেন। নিরুপায় হয়ে কর্মকর্তার কথা মত টাকা দিতে হয় সাধারণকে।

খোঁজ জানা গেছে, ভূমি কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৩০ বছরের বিল নিয়ে সেখান থেকে ১ থেকে ২ বছরের ভূমি উন্নয়ন কর সরকারী কোষাগারে জমা দেন, বাকি টাকা ভরেন নিজের পকেটে। খতিয়ানের জন্য বেশি টাকা জমা নিয়ে দাখিলা দেন অল্প টাকার।

সোহরাব মোল্লা নামের এক ভুক্তভোগী জানান, ১২৮ নং কানুরগাঁ মৌজার ৪৪ নং খতিয়ানের জন্য ১৩ হাজার টাকা নিয়েছে উপ-সহকারী আব্দুস সালাম। তিনি ২৩২৪-০০২০০৮৮৪০০নং চালান এর মাধ্যমে মাত্র ১২৩৩ টাকা জমা করেন। এর আগেও ভুক্তভোগীর কাছে থেকে ৯ হাজার টাকা নিয়ে ৯৫০ টাকার দাখিলা দেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন।

সিরাজুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তার কাছে থেকে কৌশলে ১২৪ নং স্নানঘাটা মৌজার ৪২২ নং খতিয়ানের দাখিলার জন্য ১০ হাজার টাকা নেন আব্দুস সালাম। ৫৪৪০২৩০২৬৭৮৬ নং চালানে মাত্র তিনি ৪ হাজার ৬৯০ টাকা জমা করেন সরকারী কোষাগারে। বাকি টাকা তার পকেটে রেখে দেন।

নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি নামজারি করতে গেলে তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। নিজে আবেদন করার কথা বললে ভূমি কর্মকর্তা তার আবেদন বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দেন।

নুরুল ইসলাম জানতে চান- ‘আপনি কোন কারণ দেখিয়ে বাতিল করবেন, কেননা আমার কাগজে তো কোনো ভুল নাই।’

ভূমি কমর্কর্তা সালাম তাকে জবাব দেন, ‘ভুল না থাকলে, ভুল পয়দা করে বাতিল করবো। এসি ল্যান্ড বলেন, ডিসি বলেন, আমরা একই পরিবারের লোক। যার কাছে যান কোনো লাভ নেই। আমার মাধ্যমে যারা নামজারি করে তাদের সামান্য নামে ভুল থাকলে যেমন আব্দুল করিম আছে পর্চায় আর দলিলে আছে আব্দুল করিম মিয়া। এই মিয়া থাকার কারণে উপজেলা সার্ভেয়ারকে আমার ৫ হাজার টাকা দিতে হয়।’

এমন কথা শুনে নুরুল ইসলাম ডিসির কাছে সাহায্যের জন্য যান। সেখান থেকে তারা এসি ল্যান্ডের কাছে পাঠালে নুরুল ইসলাম তার নামজারি মাত্র ১,১৭০ টাকায় করেছেন। ভুক্তভোগী আ. রাজ্জাক মোল্লা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি পেশায় পান বিক্রেতা। আমার কাছ থেকে নামজারির জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে ভূমি কর্মকর্তা।’

রাজ্জাক মোল্লার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি কষ্ট করে টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। রেকর্ড জরিপে বাড়িতে না থাকায় আমার নামে আরএস রেকর্ড করাতে পারিনি। তাই আমার নামজারি করা দরকার হয়। তাই উপ-সহকারী আব্দুস সালামের কাছে নামজারি করতে গেলে আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা চায়। পরে আমি তাকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেই। পরে তিনি আমার নামজারি করে দেন এবং সে আমায় নামজারির কাগজ দেওয়ার সময় বলে দেয় যে, ‘কারো কাছে টাকার কথা বললে এসি ল্যান্ডকে দিয়ে নামজারি বাতিল করে দিবো এবং জেলও দিতে পারে কিন্তু।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি সহকারী তহশিলদার আব্দুস সালাম বলেন, আপনি নিউজ করতে পারেন। আমার কেউ কিছু করতে পারবে না। আমার বিরুদ্ধে কোন ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ নাই।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদারীপুরের বাঁশগাড়ী,আব্দুস সালাম,অনিয়ম-দুর্নীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close