আরিফ খান, বেড়া-সাঁথিয়া (পাবনা)
শরীরে গুলি নিয়ে কাতরাচ্ছেন ‘চব্বিশের বীর’ আরিফুল
গত ৪ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে এখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছেন কলেজছাত্র আরিফুল। তার নাকে বুকে মুখে মাথায় ৬টি রাবার বুলেট ও পেটে তিনটি বুলেট লাগে। উন্নত চিকিৎসায় শরীর থেকে অন্য গুলিগুলো বের করা হলেও পেটের মধ্যে একটি গুলি এখনও রয়ে গেছে। আর একটি অপারেশন হলে তিনি স্বাভাবিক হবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। তবে তার চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তার পরিবার। বর্তমানে আরিফুল ঢাকা সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইস) হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আরিফুল পাবনা সাঁথিয়ায় উপজেলা করমজা ইউনিয়নে পুন্ডুরিয়া পশ্চিম পাড়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। সে পাবনা মনসুর আলী কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঐদিন পাবনা ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে মো. জাহিদ এবং নিলয় ঘটনাস্থলে নির্মমভাবে মারা যায় আরিফুল, দ্বীপ সহ আরো অনেকেই গুলিতে আহত হয়।
আরিফুল এর পরিবার জানায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গত ৪ আগষ্টে পাবনা শহীদ চত্তর থেকে ৯ টি গুলি বৃদ্ধ হয় ছেলে আরিফুল। গুলিতে তার পেটের নাড়ি ছিদ্র হয়ে যায়। এসময় তিনটি বুলেট এবং ছয়টি বাবার বুলেট লাগে তার শরীরে। ঐ দিনই প্রথমে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অপারেশন করে দুইটি বুলেট বের করা হয়। ৭ দিন পাবনা সদর হাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শরীরের অবস্থার অবনতি হওয়ায় ডাক্তাররা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। সেখানে ১২ দিন চিকিৎসাথীন থাকা অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আবারও তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইস) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার পুরো শরীর পরিক্ষার পর দেখা যায় পেটের মধ্যে একটি বুলেট রয়েই গেছে। তার শরীরের নানা জটিলতার কারণে একটি গুলিটি বের করতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা। তার বাথরুমের নাড়ি বাইপাস করা সেটি অপারেশন করতে হবে। একমাস বাড়িতে বিশ্রামের পর তার আরও একটি অপারেশন করা সম্ভব হবে। চলতি নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে তার অপারেশন তারিখ ঠিক করেন ডাক্তাররা।
সম্প্রতি আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে-বসে কাতরাচ্ছেন আরিফুল। তার পাশে হতাশা নিয়ে বসে আছেন মা-বাবা। সন্তান পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কি না এ নিয়ে চিন্তিত তারা। মা মোছাঃ কুলছুম খাতুনের কপালে চিন্তার ভাঁজ আর চোখে পানি।
এই প্রতিবেদকের কাছে ব্যথায় কাতর আরিফুল সেই দিনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে জানান, ছাত্র আন্দোলনে ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলাম আমি। আমি তো কোন অন্যায় করিনি, আমার সঙ্গে কেনো এমন হলো? গুলি লাগার পরে শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। একা কোনো কাজ করতে পারি না। অন্য কারও সহযোগিতা নিয়ে করতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারি না, বসেও থাকতে পারি না। রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুম হয় না। খুব অসহায় বোধ হয়। আমার ইচ্ছে ছিল বিসিএস শেষ করে দেশ ও জনগনের জন্য কাজ করার। জানিনা আমার সে স্বপ্ন পুরন হবে কি না। ৩০ নভেম্বরে তার বাকি অপরেশনের জন্য দেশবাসির কাছে দোয়া চেয়েছেন আরিফুল।
আরিফুল এর বাবা নজরুল ইসলাম জানান, আমার টানাটানির সংসার থেকেই প্রথমে ছেলের চিকিৎসা করেছি। পরে অনেকেই সহযোগীতা করেছে। বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে একদিন সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু আমাদের সাজানো স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেল! সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি বলেও তিনি জানান।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ইউরোলজি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাঃ খোঃ মেহেদী ইবনে মোস্তফা জানান, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়ক আরিফুলের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলি লাগে তবে কয়েকটি গুলি তার পেটে লেগে খাদ্যনালি ছিঁড়ে যায়। অনেক রক্তক্ষরণ হয় এতে ছয় ব্যাগ রক্ত লাগে। অপারেশনের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক তার জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে খাদ্যনালির এটি অংশ কেটে ফেলা হয় এবং নালির একটি অংশ বাইরে রাখা হয়। পরবর্তীতে তার উন্নত চিকিৎসা, মাথা ও পেট থেকে গুলি বের করার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।
পিডিএস/এমএইউ