গাজী শাহনেওয়াজ, আজারবাইজান (বাকু) থেকে
কপ২৯ এর তৃতীয় দিনেও নেই কোন দৃশ্যমান অর্জন
আজারবাইজানের বাকুতে বিশ্বনেতাদের সমাবেশে শুরু হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশগুলোর অনেকেই এবছরের চলমান জলবায়ু সম্মেলনে কোন প্রতিনিধি নেতাদের পাঠাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনে শক্তিশালী দেশগুলির প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। আজ বুধবারও (১৩ নভেম্বর) এ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। কপ২৯-এর বৈঠক শুরু হলেও তাতে ১৩টি বৃহত্তম কার্বন ডাই অক্সাইড-নির্গমনকারী দেশের শীর্ষ নেতারা থাকবেন না। বিশ্বের বৃহত্তম দূষণকারী এবং শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কোন প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে না।
এই দেশগুলো বিশ্বের চারটি সর্বাধিক জনবহুল দেশ, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৪২ শতাংশেরও এরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। আগামী সপ্তাহে শক্তিশালী দেশগুলোর নেতাদের জি২০ এর বৈঠক হবে ব্রাজিল; এ কারণে তাদের উপস্থিতি কম বলে জানা গেছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যক্তিগত অসুস্থতাও জলবায়ু সম্মেলন গুরুত্বপূণ হলেও অনেকে কম ইচ্ছা পোষন করছে। অতীত জলবায়ু সম্মেলনে প্রায়শই ফুটবল তারকাসহ বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় গায়ক-গায়িকাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। তবে এবারের কপে দেখা মেলেনি তাদের।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আজারবাইজানে জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখিত নতুন তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, তেল এবং গ্যাস থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারক নির্গমন যে বছর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল অর্থাৎ ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। অথচ কপে বলা হচ্ছে নির্গমন ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩% হ্রাস পাবে।
বিশ্বের দেশগুলো ২০২৩ সালে দুবাইতে কপ২৮-এ জীবাশ্ম জ্বালানিকে ত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে সম্মত হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তকে একটি যুগান্তকারী হিসাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল কারণ পূর্ববর্তী ২৭টি শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যে কেউই বিশ্বব্যাপী উষ্ণতার প্রাথমিক কারণের উপর বিধিনিষেধের আহ্বান জানায়নি। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে দূরে যাওয়ার কোন চিহ্নের দেখা মিলছে না। বিশ্বের দেশগুলো এক বছর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২৪ সাল বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের জন্য আরেকটি নতুন রেকর্ড স্থাপনের পথে হাঁটবে যার কোন প্রতিফলন এখনো দৃশ্যমান নয়। ১.৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখার এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের উপর "ক্রমবর্ধমান নাটকীয়" জলবায়ুর প্রভাব সীমিত করার সুযোগ বিশ্বের কাছে এখনো রয়েছে। সুইডেন লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলে ২০ মিলিয়ন ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮১% নির্গমন কমানোর নতুন লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছানোর কথা রয়েছে ১০০% ক্লিন এনার্জি সরবরাহে। তিনি বলেন, “জলবায়ু নিরাপত্তা ছাড়া কোনো জাতীয় বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সম্ভব নয়।”
এদিকে, কপ২৯ এর আয়োজক আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ আর্মেনিয়া, পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম, জলবায়ু কর্মী এবং তার দেশের সমৃদ্ধ তেল ও গ্যাসের ইতিহাস ও বাণিজ্যের সমালোচকদের নিন্দা করে বলেন, "আমরা সমন্বিত অপপ্রচারের শিকার।” আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট বিশ্ব নেতাদের নির্ধারিত দুইটি দিনের বক্তৃতা শুরু করেছেন এবং তাদের কথাকে ভণ্ডামি উল্লেখ করে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী দেশ। তিনি আরও বলেন যে, আজারবাইজানকে পেট্রোস্টেট বলা ন্যায্য নয় কারণ এটি বিশ্বের ১ শতাংশেরও কম তেল এবং গ্যাস উৎপাদন করে। তিনি তেল এবং গ্যাস, সূর্য, বায়ু এবং খনিজগুলির মতোই "সৃষ্টিকর্তার উপহার" হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আলিয়েভ বলেন যে তার দেশকে তিনি জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে দূরে সরে গিয়ে গ্রীন এবং ক্লিন এনার্জি ব্যবহারের জন্য কঠোরভাবে চাপ দেবেন। আর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বনেতাদের বলেছেন, নিশ্চিতভাবে বিশ্ব রেকর্ডে এটি সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হবে। তবে গুতেরেস আশা প্রকাশ করে বলেন, "ক্লিন এনার্জির বিপ্লব এখানেই। কোনো গোষ্ঠী, কোনো ব্যবসা, কোনো সরকার এটা বন্ধ করতে পারবে না।” জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে ট্রাম্প যখন ২০১৬ সালে প্রথম নির্বাচিত হন, তখন বিশ্বে ১৮০ গিগাওয়াট ক্লিন এনার্জি এবং ৭০০,০০০ বৈদ্যুতিক যানবাহন ছিল যা বর্তমানে বেড়ে গিয়ে ৬০০ গিগাওয়াট ক্লিন এনার্জি এবং ১৪ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক যানবাহনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রগুলো বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার প্রায় বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে আলোচনা করছে।
গুতেরেস বলেন, “এই অর্থ দাতব্য নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাকু থেকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়।” জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ বন্যা রোধে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পানি ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘পানি আমাদের প্রধান পরিবেশগত সমস্যা। আমাদের এমনভাবে পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে যাতে তা প্রকৃতিকে সমর্থন করে। প্রধান উপদেষ্টা বুধবার নেপাল ও ভুটানে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎয়ের জন্য একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটানকে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রিড তৈরি করার কথা ভাবতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনুস বলেন, ‘বাংলাদেশ সহজেই নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনতে পারে কারণ এটি বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে। নেপালের জলবিদ্যুৎ সহজলভ্যও হবে।’তিনি কপ ২৯ এর মূল বিষয় এবং কার্বন ক্রেডিট নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানের বিষয়েও কথা বলেছেন। তিনি তার তিন শূন্যের স্বপ্নকে সম্মেলনে সবার সম্মুখে উপস্থাপন করে বলেন, “প্রতিটি যুবক তিন শূন্য ব্যক্তি হিসাবে বেড়ে উঠবে — শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদের ঘনত্ব, শুধুমাত্র সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে এবং নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব। প্রতিটি ব্যক্তি তিন শূন্য ব্যক্তি হিসাবে বেড়ে উঠবে এবং সারা জীবন তিন শূন্য ব্যক্তি হিসেবে থাকবে। একটি নতুন সভ্যতা তৈরি করবে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ উল্লেখ করেছেন যে গত মাসে তার দেশে সংঘটিত মারাত্মক বন্যাটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়া সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল এবং তীব্রতাও কম হত। তিনি বলেন, "আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা আর বৃদ্ধি পাবে না। প্যারিসে সাত বছর আগে আমরা যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবার তা বাস্তবায়ন করতে হবে।"
এই বছরের আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হল জলবায়ু অর্থায়ন যেখানে ধনী দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেবে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে গিয়ে তাদের অর্থনীতিকে গ্রীণ এবং ক্লিন অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে অর্থ প্রদান করবে এবং অভিযোজনে সহায়তা করবে৷ তবে ধনী দেশগুলি এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থায়নের আলোচনা নিয়ে টালবাহানা করে কপের গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা করছে। তারা তাদের অর্থ পরিশোধের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে।সকল বাঁধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে পর্যাপ্ত লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড সংগ্রহ করা এবং জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মাঝে সমবন্টন করা এখন বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদেরকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্যারিস চুক্তিকে টার্গেট করে কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং জীবাশ্ম জ্বালানিকে ফেইজ আউট বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে পারলেই কেবল আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারব।