গাজী শাহনেওয়াজ
সচিবশূন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, ডিসি নেই আট জেলায়
মন্ত্রণালয়ের সব কাজের ভার সচিবদের ওপর। উপদেষ্টাদের পর সচিবরাই হচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত দপ্তরগুলোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক। কিন্তু বর্তমানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ চলছে সচিব ছাড়াই। অতিরিক্ত সচিবরা রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদও শূন্য রয়েছে আট জেলায়। ফলে মাঠের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাড়ছে জটিলতা।
অবশ্য যোগ্যদের সচিব নিয়োগে যাচাই-বাছাই করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে সাবেক সরকারের আমলে বঞ্চিত ও পদোন্নতিপ্রত্যাশী কর্মকর্তারা বলছেন, তারা প্রশাসনে নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না। কারণ একটি সচিবের পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলে অন্তত তিন থেকে পাঁচ কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হন। ফলে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড যেমন বিঘ্নিত হয়, তেমনি হতাশার সৃষ্টি হয়। এতে প্রশাসনিক কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কয়েকটি জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় ওঠে, যা পরবর্তী সময়ে বাতিল করতে হয়। এসব জেলায় এখনো ডিসি নিয়োগ না হওয়ায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে যোগ্য কর্মকর্তাদের (উপসচিব) যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে শূন্যপদে ডিসি নিয়োগের কাজ করছে সরকার। পাশাপাশি সচিব পদেও নিয়োগ নিয়ে কাজ করছে।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সচিব পদে বড় ধরনের রদবদল আনা হয়। বিগত সরকারের আমলে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া সচিবদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জননিরাপত্তা সচিবসহ কয়েকটি সচিব পদে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন- এমন কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। এরপরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে এখনো সচিব পদায়ন করা হয়নি। এসব মন্ত্রণালয়ে বিগত সময়ে পদোন্নতিবঞ্চিত কিছু কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। এর এক দিন পর ২ অক্টোবর তাকে ওএসডি করে সরকার। আবার খাদ্য ক্যাডারের পরিচালক (অবসরপ্রাপ্ত) ইলাহী দাদ খানকে ৩০ সেপ্টেম্বর চুক্তিতে খাদ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় পরদিন তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. মোকাব্বির হোসেনকে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। ১৭ আগস্ট মোকাব্বিরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বদলি করা হয়। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, সচিবের কয়েকটি পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো শিগগিরই পূরণ করা হবে। সেজন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের বাছাই করা হচ্ছে। সচিব পদ বেশি দিন শূন্য রাখা যাবে না। একইভাবে জেলা প্রশাসক পদেও নিয়োগ দেওয়া হবে।
ডিসি ছাড়াই চলছে আট জেলা : গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার পর ১১ সেপ্টেম্বর তাদের মধ্যে আটজনের নিয়োগ বাতিল করায় এসব জেলার ডিসির পদ ফাঁকা হয়ে যায়। কাউকে পদায়ন না করায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরাই রুটিন কাজ করছেন। জেলাগুলো হলো- রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও দিনাজপুর। এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত মো. আবদুর রউফ বলেন, দ্রুত পদায়ন দিতে তারা চেষ্টা করছেন। আপাতত ডিসি নিয়োগে নতুন করে আর কোনো ফিট লিস্ট করা হবে না। ডিসি নিয়োগের যে ফিট লিস্ট রয়েছে, সেখান থেকেই আট জেলায় ডিসি পদায়ন করা হবে।
সচিব পদে পরিবর্তন এসেছে ২৭ মন্ত্রণালয়ে : বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত ২৭ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদে নতুন মুখ এসেছে। এর মধ্য তিনজনের দপ্তর বদল হয়েছে। কেউ কেউ চুক্তিতে এসেছেন। ৮ আগস্টের পর নতুন করে চুক্তিতে সিনিয়র সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ড. মো. আবদুর রশীদ (মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন সম্প্রতি), রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ড. নাসিমুল গণি, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব পদে এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ড. মো. মোখলেস উর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মো. এহছানুল হক, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে এম এ আকমল হোসেন আজাদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে সিদ্দিক জোবায়ের ও ভুমি মন্ত্রণালয়ে এ এস এম সালেহ আহমেদকে।
এছাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে মো. হামিদুর রহমান খান, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগে ডা. সারোয়ার বারী, সংসদ সচিবালয়ে ড. আনোয়ার উল্লাহ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নাসরীন জাহান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি (পরে বাধ্যতামূলক অবসর), কৃষি মন্ত্রণালয়ে ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মো. জসীম উদ্দিন, বিদ্যুৎ বিভাগে ফারজানা মমতাজ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে মো. মাহবুব হোসেন, সেতু বিভাগে মো. ফাহিমুল ইসলাম, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে মো. মাসুদুল হাসান, শ্রম ও কর্মসংস্থানে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগে শীষ হায়দার চৌধুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আবদুল বাকী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে মো. মোকাব্বির হোসেন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও এনবির আর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
চুক্তি নিয়োগে পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা হতাশ : চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রশাসনে নেতিবাচক চোখেই বরাবর দেখা হয়। বর্তমান সরকারের আমলেও নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন, জননিরাপত্তা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে বলছেন, অতীতের সরকারগুলোর পথেই হাঁটছে এ সরকারও। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধই করা যাচ্ছে না। ৮ আগস্টের আগ পর্যন্ত বিগত শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে প্রশাসনের দুই শীর্ষ পদসহ অন্তত ২৪টি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন অবসরে যাওয়া সাবেক আমলারা। এ নিয়ে প্রশাসনে এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েই উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক দিনেই ১১ সচিবের চুক্তি বাতিল করা হয়। পরে আরো কয়েকটি পদের চুক্তি বাতিল করে সরকার। এরপর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় প্রশাসনে। তারা অধিকাংশই বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তা (বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত)। এরপর ধাপে ধাপে আরো কিছু পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তারা প্রশাসনে নতুন করে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না। কারণ একটি সচিবের পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলে অন্তত তিন থেকে পাঁচ কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হন। ফলে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড যেমন বিঘ্নিত হয়, তেমনি হতাশার সৃষ্টি হয়। এতে প্রশাসনিক কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে আসে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, চুক্তি ছাড়া বর্তমান সরকারের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে গতিশীল করতে হলে অতীতের বঞ্চিত ও বর্তমান প্রশাসনে যাদের নিয়ে দলীয় বিতর্ক নেই- এমন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের দায়িত্ব দিতে হবে। পরে ধীরে ধীরে তা নিয়মের মধ্য আসবে।