গাজী শাহনেওয়াজ
ক্রীড়াসামগ্রী ক্রয়ে বরাদ্দের আগেই বিল উত্তোলন
প্রতি বছর ক্রীড়াসামগ্রী কেনার জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বরাদ্দ কার্যক্রম শুরুর আগেই টাকা উত্তোলন হয়ে যায়। রাজধানীর ক্রীড়া পরিদপ্তরে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে—এই লঙ্কাকাণ্ড। সব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হলেও যেন দেখার কেউ নেই। কালেভদ্রে কারো নজরে এলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তড়িৎ পরিদপ্তর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এক্ষেত্রে দুষ্টু, দুর্নীতিবাজ ও অসাধুচক্র থাকে একাট্টা।
এদিকে, উত্তোলিত অর্থের বিপরীতে কর্মকর্তারা সরবরাহ করেন ভুয়া ভাউচার এবং জাল স্বাক্ষর। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চাহিদাপত্র পেলেই অর্থছাড়ে মরিয়া হয়ে উঠেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টস এবং ফিন্যান্স অফিসার।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে এরই মধ্যে নিয়েছেন বেশ কিছু উদ্যোগ। দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দেশের ৪৫টি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিদের অব্যাবহতি দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ক্রীড়া ফেডারেশন সাজাতে তৈরি হয়েছে সার্চ কমিটি।
এরই ধারাবাহিকতায় গত সেপ্টেম্বরে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটের দোকান বরাদ্দের বিষয়গুলো সরেজমিনে দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন। ফেরার পর ক্রীড়া উপদেষ্টা তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন, ‘আজ এনএসসির অধীনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দোকান পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ২০-২২ টাকা/বর্গফুট হিসেবে এনএসসির কাছে ভাড়া গেলেও সরেজমিন গিয়ে জানতে পারলাম, দোকানগুলো ১৭০-২২০ টাকা/বর্গফুট করে ভাড়া দিচ্ছে। বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সরকার। অর্থাভাবে ফেডারেশন চলছে না, টুর্নামেন্ট হয় না, মাঠের সংস্কার হয় না। অথচ বছরের পর বছর এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি গেছে। ক্রীড়া উপদেষ্টার মনে হচ্ছে, তাকে দুর্নীতির মহাসাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে দেশের সব ক্রীড়া ফেডারেশনে পরিবর্তনের হাওয়া বইলেও ব্যতিক্রম ক্রীড়া পরিদপ্তর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ক্রীড়া পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) আ ন ম তরিকুল ইসলাম পদে বসে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন এমন অভিযোগ তুলে দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তার অপসারণ চেয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে। ঘটনার গভীরে গিয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন চিত্র। মূলত, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভুয়া বিল ভাউচার ও জাল স্বাক্ষরে ক্রীড়াসামগ্রীর টাকা উত্তোলনে সহযোগিতা না করায় তার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন ষড়যন্ত্রকারীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্রীড়া পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) আ ন ম তরিকুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা কথায় বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। মূলত কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ভুয়া বিল ভাউচার ও জাল স্বাক্ষর দিয়ে বার্ষিক বরাদ্দের ক্রীড়াসামগ্রীর টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যান।
তিনি বলেন, টাকা উত্তোলনে সমস্যা নেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে অন্য জায়গায়। ক্রীড়াসামগ্রীর বরাদ্দের টাকা ছাড়ের সময় হয়নি এবং এমনকি ক্রীড়াসামগ্রী কেনাও হয়নি অথচ বিল করে বছরের পর বছর টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায় চক্রটি।
তরিকুল ইসলাম বলেন, আমি দায়িত্বে বসার পর বিষয়টি গোচরে এলে আপত্তিকর বিল আটকে দিই। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ নানা মিথ্যা অপবাদ চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল আছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রকৃত সত্য জানলে ওই দুর্নীতিবাজদের চাকরি থাকবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ক্রীড়া পরিদপ্তরের বিভিন্ন কোডে প্রাপ্ত সরকারি বরাদ্দ থেকে কোনো টাকা উঠানো হয়নি। অথচ অর্থবছরের এ সময়ে (১ম প্রান্তিক) মোট বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ সাড়ে ৪ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন হয়ে যেত। সঠিক চাহিদাপত্র ও যথাযথ কারণ ছাড়াই বরাদ্দপত্র না পাওয়ায় এ বছর অক্ষত রয়েছে ক্রীড়া দপ্তরের তহবিল।
তথ্য সূত্র বলছে, বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি বরাদ্দ চলতি বছরে এখনো জেলা ক্রীড়া অফিসারদের অনুকূলে ছাড় করা হয়নি। আগাম অর্থ নিয়ে যে চক্রটি পুরাটাই আত্মসাৎ করতেন, ওই অসাধু চক্রটিই পরিচালককে অপসারণের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে ক্রীড়াসামগ্রী না কিনে আগাম অর্থ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত চক্রটির ‘আতে ঘা পড়ায়’ চরম ক্ষেপেছেন। অবৈধ অর্থে এতোদিন আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া কর্মকর্তাদের এই চক্রের অন্যতম ক্রীড়া পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ফেরদৌউস আলম, সহকারী পরিচালক (সংগঠন) আলীমুজ্জামান এবং সহকারী পরিচালক আজিম হোসেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্রীড়া পরিদপ্তরের ছাড়কৃত অর্থ ব্যয় না হওয়ায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা তহবিলে ফেরত আনা হয়েছে। এর আগে এই নজির ছিল না। আবার বরাদ্দ হওয়া অর্থের কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় ছাড় করা হয়নি চলতি আর্থিক বছরের অর্থ। এর ফলে ক্রীড়া পরিদপ্তরের স্বচ্ছতা যেমন বাড়ছে, তেমনি সরকারের আর্থিক আশ্রয় হচ্ছে।
ময়মনসিংহ সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোমিনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ায় গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচালকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
খুলনা জেলা ক্রীড়া অফিসার মো. বকতিয়ার রহমান বলেন, পরিচালকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটি ভুয়া, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বরাদ্দ প্রদানের আগেই বাস্তবায়ন : বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি বরাদ্দ চাওয়া হয়নি। এর আগেই অর্থ উত্তোলনের জন্য চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারের অনুকূলে বাস্তবায়ন ব্যয়ের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। নথির তথ্যে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সাঁতার প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে গত বছরের ২ অক্টোবর। অথচ জেলা ক্রীড়া অফিসারদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ, বরাদ্দ পাওয়ার দুই মাস আগে গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সাঁতার প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের ব্যয়ের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়; সেটিও স্বাক্ষরবিহীন। এদিকে চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার কোনো যাচাই ছাড়াই বিলের টাকাও পরিশোধ করে দেন। এভাবেই চলে আসছে ক্রীড়া পরিদপ্তরে লুটপাট।
বিষয়টি নিয়ে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হলে ঢাকা জেলার সাবেক ক্রীড়া অফিসার মো. রেজাউল করিম ও চট্টগ্রামের জেলা ক্রীড়া অফিসার হারুন ওর রশীদ আগাম অর্থ বরাদ্দের কথা স্বীকার করেন। তারা বলেন, বছর বছর আমরা এভাবেই (বরাদ্দ পাওয়ার আগেই বাস্তবায়ন) পেয়ে আসছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটাই শিখিয়েছেন।
এ বিষয়ে ক্রীড়া পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ফেরদৌউস আলম ও সহকারী পরিচালক (সংগঠন) আলীমুজ্জামান শুনানিতে উপস্থিত থাকলেও কোনো জবাব দেননি।
প্রশিক্ষণের স্থানের নাম না লেখা : প্রশিক্ষণের স্থানের নাম না লেখা বা উল্লেখ না করা ক্রীড়া পরিদপ্তরের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এটি বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করার এক অভিনব কৌশল। যাতে যাচাই না করতে পারেন সেজন্য প্রশিক্ষণের স্থানের নাম লেখেন না কর্মকর্তারা। ক্রীড়া কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এভাবেই চলে আসছে। কখনো কেউ এভাবেই দেখেনি। কোনো পরিচালক বাস্তবায়িত ক্রীড়া কর্মসূচির ডকুমেন্টস দেখেছেন, সেটা তাদের জানা নেই। আলীমুজ্জানও স্বীকার করেন, আগে কখনো দেখা হয়নি।
ভুয়া ভাউচারে টাকা উত্তোলন : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাস্টার রোল কর্মচারীরাই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরিতে সহায়তা করেন। অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্যাড তারা কম্পিউটারে তৈরি করেন। আবার একজন অন্যজনেরটা তৈরি করে দেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া অফিসের অফিস সহায়ক কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. মহসিন মিয়া নিজের অফিসের বাইরে অন্য অফিসের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে দেন বলে নথি পর্যালোচনায় পাওয়া গেছে। ভুয়া বিল করার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্বীকার করেছেন মোহসিন। এই মহসিনের নিয়োগ পরীক্ষার খাতায় বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন ডিডিও লেখা রয়েছে বলে তদন্তে বের হয়ে এসেছে। ২০২১ সালে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অবৈধ ছিল সেটি তদন্তে উঠে আসে।
এছাড়া ভাই ভাই খেলাঘর, বি. টেক্স ও বিজনেস ওয়ার্ল্ড (বি. টেক্স) প্রোপ্রাইটর মো. কবির হোসেন, যাত্রাবাড়ীর কাজলা ব্রিজ সংলগ্ন পানির পাম্প ঠিকানা উল্লেখ করা আছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে ফাঁকা ও সাদা ভাউচার ৬৪ জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে জেলা ক্রীড়া অফিসাররা ইচ্ছামতো বিল লিখে নিজেরা স্বাক্ষর করেন। ফলে অর্থ বছর শেষে এই কবির হোসেনের স্বাক্ষর ১৫০ থেকে ২০০ রকম হয়। কবির হোসেনের এই তিনটি প্রতিষ্ঠান বার্ষিক ক্রীড়া কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় বলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা জেলার ক্রীড়া অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বেনামে ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। মো. কবির হোসেন একজন কাল্পনিক ব্যক্তি। এমনকি দাখিলকৃত মাস্টাররোল অধিকাংশ ৯০ শতাংশ ভুয়া এবং নিজেদের তৈরি করা; প্রশিক্ষণার্থীদের শুধু নাম ছাড়া অন্য কোনো তথ্য না লেখা নামে অর্ধেক লেখা এবং পিতা-মাতা ও ঠিকানা উল্লেখ না করা। কোচের সম্মানী গ্রহণের স্বাক্ষর জাল, স্ব স্ব জেলা ক্রীড়া অফিসার কর্তৃক স্বাক্ষরিত।