গাজী শাহনেওয়াজ
জেলা প্রশাসক নিয়োগে বিতর্ক থামছে না
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে থামছে না বিতর্ক। লোক দেখানো ভাইভা নিয়ে পুরোনো ফিটলিস্ট থেকে ডিসি নিয়োগ দেওয়ায় এ বিতর্কের সূচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এ আশঙ্কায় তাদের প্রত্যাহারে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে মানববন্ধন।
এদিকে, একজন উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন, এখন থেকে কারো বদলি ও পদোন্নতির প্রস্তাব উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানোর আগে কে এবং কী কারণে করা প্রয়োজন, সেটির ব্যাখ্যাসংবলিত সারসংক্ষেপ পাঠাতে হবে। এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অভিভাবক এক সিনিয়র সচিব আক্ষেপ করে বলেছেন এসব বিষয়ে আমার কিছুই করার থাকে না। আমি শুধু ফাইল দেখভাল করে থাকি। তবে এ প্রতিবেদনে তিনি নাম প্রকাশে ইচ্ছুক হননি।
ডিসি নিয়োগের বিতর্কের মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকার ডিসি মো. তানভীর আহমেদের প্রত্যাহার চেয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে। ঢাকার সর্বস্তরের নাগরিক সমাজের ব্যানারে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি হয়। দাবি মেনে না নিলে জেলা প্রশাসককে অসহযোগিতাসহ আরো বড় ধরনের কর্মসূচি পালনের হুমকি দেওয়া হয়। এর আগে রবিবার লক্ষ্মীপুরের নবনিযুক্ত ডিসি রাজীব কুমার সরকার এবং তার আগের দিন খুলনার ডিসির অপসারণ চেয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন লক্ষ্মীপুর ও খুলনার সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ। তার আগে নাটোরের ডিসির বিরুদ্ধে মানববন্ধন হলে তাকে লক্ষ্মীপুর বদলি করা হয়।
এদিকে ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিটি নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ৫৯টি জেলার ডিসি নিয়োগের পর এসব কর্মকর্তাদের আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপরই নড়ে চড়ে বসে সরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৮ জন ডিসির নিয়োগ বাতিল এবং ৪ জনের রদবদল করা হয়। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের এ ক্ষোভের বিষয়টি তদন্তে স্বাস্থ্য সচিব আকমল হোসেন আজাদকে প্রধান করে পরদিনই এ কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। তবে ডিসি নিয়োগের সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) বোর্ডে থাকা এ সদস্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেই ৭ জনকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যা নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক উঠে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এ কমিটি সেদিনের ঘটনা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ৭ জন কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রেজাউল মকসুদ জাহেদীর কক্ষে বক্তব্য গ্রহণকালে এক রকম পুলিশের ইন্টারোগেশন সেলের মতো আচরণ করে কমিটি। এমনকি আলাদাভাবে ১৫ মিনিট থেকে প্রায় ৩০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য গ্রহণকালে সরকারি এসব কর্মকর্তাদের কাউকেই বসতে দেওয়া হয়নি। এ থেকে বাদ যাননি কোনো মহিলা কর্মকর্তাও।
এ সময় প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হয় কর্মকর্তাদের। বলা হয়, সরকারের পতনে তিনিসহ সরকারি কোনো কর্মকর্তারই কোনো ভূমিকা ছিল না, বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান। তবে এর বিরোধিতা করে বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নিজেদের নানা ভূমিকার কথা তুলে ধরলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, কোনো সরকারের পতন করা কর্মকর্তাদের কাজ নয়। এমনকি যারা সরকার পতনে ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেন এই সচিব। তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা ছাত্রদল করে প্রশাসনে এসেছেন পদোন্নতি বা পদায়নে সেটি বিবেচনায় নেওয়ার বিষয় নয়। তদন্ত কমিটির প্রধানের এমন আচরণে ব্যাপক ক্ষুব্ধ বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা। তাদের কেউ কেউ কমিটি প্রধানকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাহলে ৫৯ জন ডিসির মধ্যে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ পরিবার ও তাদের সুবিধাভোগী কীভাবে পদায়ন হলেন! তবে এই প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে বাধ্য নন বলে জানান। তিনি বলেন, এটি এসএসবির সুপারিশে হয়েছে। এতে প্রধান উপদেষ্টা তাদরে ডিসি নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
সূত্রগুলো জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও বিভিন্ন স্থানে ওই সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একযুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে সরকার। গত প্রায় মাসখানেক ধরে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে ফিটলিস্ট তৈরি করা হলেও সেখানে বিগত সরকাররে সুবিধাভোগী ও আওয়ামী পরিবারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, হট্রগোলে জড়ান বঞ্চিত ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা। এসব ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দফায় ৫৯টি জেলায় ডিসি নিয়োগ দেওয়া হলেও বুধবার ৮টি জেলার ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। পাশাপাশি চারজনের পদায়ন করা জেলা বদল করা হয়েছে। ৫১টি জেলার ডিসি তাদের নতুন পদে যোগদান করেছেন। এর আগে এক আদেশে পদায়ন করা ডিসিদের কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে আপাতত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে প্রশাসনের চরম এ অস্থিরতার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনু বিভাগের দুজন যুগ্মসচিবকে দায়ী করছেন বিক্ষুব্ধরা। তাদের একজনকে গত বুধবার সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ত্যাগী, বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ পরিবার সংশ্লিষ্ট এবং বিগত ১৫ বছরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদেরই আবার ডিসি পদে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এপিডির একজন যুগ্মসচিব। সেজন্য অবিলম্বে ডিসি নিয়োগ দেওয়া এসব প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে বাতিলের দাবি তাদের।
ডিসি নিয়োগ নিয়ে এখনো অস্বস্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোখলেস উস রহমান নিজেই। জানা গেছে, একজন উপদেষ্টা তার দপ্তরে কার্পেটে বসিয়ে তার নির্দেশিত নাম টাইপ করিয়ে ডিসি নিয়োগ চূড়ান্ত করেন। জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব ওই কর্মকর্তা আপসোস করে মন্তব্য করেছেন তিনি কারো পদোন্নতি বা ডিসি হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে তদবিরকারী হিসেবে ভূমিকা রাখেন না।