প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন 

রাজপথে নেমে এসেছিল নরীদের ঢল

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন ইতি টানার জন্য হাজার হাজার মানুষ যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন একটি বিষয় ছিল আলাদাভাবে নজর কাড়ার মতো। সেটি হচ্ছে, আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক নারীদের অংশগ্রহণ। রাস্তায় নেমে অসংখ্য নারী পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী শ্লোগান দিয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশের আন্দোলনগুলোতে এত নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। আন্দোলনে নারীদের এই অংশগ্রহণের বিষয়টিকে অভূতপূর্ব হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তারা বলেছেন আন্দোলনকারী সন্তানদের সাহস যোগাতে রাজপথে নেমে আসেন নারীরা। এক পর্যায়ে পরিবারের সবাই নামে রাজপথে। দাবি ওঠে ‘‘ এক দফা এক দাবি / শেখ হাসিনা কবে যাবি। খবর বিবিসির।

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ফারজানা লিও একজন পেশাদার বডি বিল্ডার। তিনি নিজে কাজিপাড়া ও শ্যাওড়াপাড়া এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন ও শ্লোগান দিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, এই আন্দোলনের সাথে নারীরা যদি একাত্ম না হতো তাহলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হতো না। নারীরা যখন ব্যাপক সংখ্যায় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে যায় তখন তাদের পক্ষে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।

ফারাজনা লিও তার জীবনে কখনোই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না। নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের গুলি করে মেরেছে সেটি দেখে বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। এই বিষয়টি তাকে রাস্তায় টেনে নামিয়েছে।

“আমি মনে করেছি যে রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলেদের রক্ষা করতে হবে। এটা আমি ভেবেছিলাম,” বলছিলেন ফারজানা লিও। রাস্তায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আন্দোলন করতে দেখে তিনিও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ যতই বাড়ছিল, সেটি পুরুষদের মনেও সাহস যোগাচ্ছিল।

তিনি বলেন, বহু নারী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে আবার অনেকে বাড়িতে থেকেও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। সন্তান যখন তার মায়ের দিক থেকে সাপোর্ট পায় তখন কোন কিছুই তাকে আটকাতে পারে না। “মায়ের দিক থেকে যখন আপনি সাপোর্ট পাবেন, তখন সন্তান বলেন আর সহকর্মী বলেন, সবারই বুকের সিনা টান হয়ে যায়। মা যদি সাহস দেয় যে তুমি যাও, তুমি না গেলে দেশের কী হবে? তুমি না গেলে এই দেশকে কে রক্ষা করবে? এই সাহসটা তো ঘর থেকে আসতে হবে। আপনি যদি ঘর থেকে পিছন থেকে টেনে ধরে রাখেন, তাহলে সে কী করে সামনে এগুবে?” বলছিলেন ফারজানা লিও।

হাইকোর্টের রায়কে কেন্দ্র করে জুলাই মাসের শুরুর দিকে প্রথমে শুরু হয় কোটা বিরোধী বিক্ষোভ। এরপর ধীরে ধীরে সে আন্দোলন সরকার পতনের একদফায় এসে ঠেকে। ছাত্ররা একদফা ঘোষণার পর শেখ হাসিনা আর বেশিদিন ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। একদফা ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে গত ৫ই অগাস্ট পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে অগাস্ট মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত সাড়ে ছয়শ মানুষ নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা ৮০০’র বেশি। মোট কতজন নিহত হয়েছে সেই পরিষ্কার চিত্র এখনো অজানা।

নিহতদের মধ্যে বিক্ষোভকারী ছাত্র, রাজনৈতিক দলের কর্মী, পথচারী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রয়েছে। অনেকে ঘরের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে শিশুরাও আছে।

ঢাকার পূর্বাচলে বসবাস করেন ১৬ বয়সী রিদিমা। পড়াশুনা করেন ঢাকার একটি সুপরিচিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। রিদিমার ভাইও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা থাকবে কী না সেটি নিয়ে তাদের কোন ভাবনা ছিল না। কিন্তু পুলিশের গুলিতে যখন শিক্ষার্থীরা নিহত হচ্ছিল রিদিমা ও তার ভাইও বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। এই বিক্ষোভে সন্তানদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মা-বাবাও।

রাস্তায় গুলি আর নিহত হবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা সপরিবারে ক্ষোভে গিয়েছিলেন? “মাতৃত্বটা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। সন্তান যারই হোক না কেন, প্রত্যেকটা মা মনে করে প্রতিটা সন্তানই আমাদের সন্তান। যখন আমরা দেখলাম যে ভয় পেয়ে তো লাভ নেই, আমাদের বাচ্চাদের তো আমরা বাঁচাতে পারছি না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। তারপরেও তাদের টর্চার করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে। তখন তো আমাদের আর ভয় পেয়ে কোন লাভ নেই। আমরা ঘরে থেকে কী করবো।” নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন সন্তানদের সঙ্গে অংশ নেওয়া এক নারী।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বুলবুল সিদ্দিকী বলছেন, বহু মেয়েরা মিছিল কিংবা কিংবা বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল মিছিলে অংশ নেওয়া তাদের সহপাঠী কিংবা ভাইদের রক্ষা করা।

“আমাদের এখানে একটা ধারণা আছে মিছিলে মেয়েরা সামনের সারিতে থাকলে তাদের ওপর পুলিশ হয়তো সেভাবে চড়াও হবে না। কিন্তু এই ধারণা এবার কাজে লাগেনি। মেয়েরাও আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তারা রাস্তা ছেড়ে যায়নি,” বলছিলেন সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬০’র দশকে বিভিন্ন আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। এছাড়া ১৯৯০’র দশকে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনেও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ অতীতের সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল বলেও মনে করেন তিনি।

এই আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ করার আরেকটি কারণ আছে। সেটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ মেয়েদের উপর আক্রমণ করেছে। লাঠি দিয়ে ছাত্রীদের পেটানোর এসব ছবি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে তখন মানুষ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাবার পর প্রায় একমাস অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

পাঁচই অগাস্টের পরে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে শিক্ষার্থীরা নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার মাধ্যমে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা।

এসব গ্রাফিতির মাধ্যমে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, বৈষম্যহীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা বলা হচ্ছে।

ঢাকার মিরপুরে দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সালওয়া সারা। তিনি বিবিসিকে বলেন, “ আমি চাই আমাদের তরুণদের মতামতের গুরুত্ব দেবে সরকার। আমি একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই।” আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানজিনা আফরিন বলছিলেন, “ আমি চাই আমার জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের যাতে ভূমিকা থাকে। আমি যাকে ইচ্ছে ভোট দিতে পারবো। এটাই আমার চাওয়া। ”

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close