মেগা প্রকল্প : পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল ও কর্ণফুলী টানেল
লাভ দূরের কথা, বিনিয়োগ তোলাই চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গত ১৫ বছরে অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। এজন্য মেগা প্রকল্পের নামে উচ্চ সুদে বিদেশি ঋণ নিয়েছে তৎকালীন সরকার। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এ কারণে বিনিয়োগ তোলা আনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু থেকে এক বছরের আয় এসেছে দুই বছরে, মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ উঠতে লাগবে ৪৫ বছর ও কর্ণফুলী টানেলে দৈনিক আয়ের তুলনায় ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর পরামর্শকে পাশ কাটিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পসহ সড়কের আরো অনেক প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বেশ কিছু প্রকল্প শেষ হলেও এসব প্রকল্পের লাভ তো দূরের কথা, বিনিয়োগ তুলে আনাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি ছিল আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর একটি। বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ বাতিল হওয়ার পর সেটি নির্মাণ করা হয়েছে দেশীয় অর্থায়নেই। ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ২০২২ সালের জুনে এটি উদ্বোধন করা হলেও এখনো বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে।
২০২২ সালে সেতুটি উদ্বোধনের পর সেতু কর্তৃপক্ষ ধারণা করেছিল শুধু টোল আদায়ের মাধ্যমে প্রথম বছরই আয় হবে ১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। কিন্তু দুই বছর পর চলতি বছরের জুন শেষে এ সেতুর মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের প্রত্যাশিত আয় এসেছে দুই বছরে। সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে প্রথম বছরে মোট ৫৭ লাখ ১৭ হাজার ৪৬টি যানবাহন পার হয় এবং টোল আদায় হয় মোট ৮০১ কোটি ৪৪ লাখ ২৭ হাজার ২০০ টাকা। দ্বিতীয় বছরে মোট যানবাহন পারাপার হয়েছে ৬৯ লাখ ৯৬ হাজার ২২৯টি এবং মোট টোল আদায় হয়েছে ৮৪৭ কোটি ৩১ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টাকা।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি নির্মাণ হচ্ছে চীনের ২৬০ কোটি ডলার ঋণ অর্থায়নে। ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ শতাংশ। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসেবে আছে আরো দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে নির্ধারিত পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে এখনো এর ঋণ পরিশোধ শুরু হয়নি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ১৫ বছর ধরে এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।
এ প্রকল্পগুলোয় ব্যবস্থাপনা জোরদার করার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফাকে মুজেরী বলেন, যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে এগুলোকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা যায়, তাহলেই বিনিয়োগ তুলে আনা সম্ভব। কারণ এ টাকাগুলো এরই মধ্যে সেখানে বিনিয়োগ হয়ে গেছে, তা বন্ধ করারও কোনো প্রশ্ন নেই। এ ছাড়া দুর্নীতিও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তা না হলে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দুর্নীতি বন্ধ ও ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে না করা যায় তাহলে কোনো প্রকল্পই সফলতার মুখ দেখবে না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এখনো আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো যদি যাতায়াতের করিডোর হিসেবে থেকে যায়, তাহলে অবশ্যই বড় শঙ্কার ব্যাপার ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে। এ প্রকল্পগুলো যাতায়াত করিডোর থেকে অবশ্যই অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক করিডোর করতে হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। সেখানে শিল্পকারখানা ভারী কারখানা আমরা সুপরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা যদি সময়মতো না নিতে পারি, সেখানে বড় ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এত বড় বিনিয়োগ শুধু যাতায়াতের করিডোর হওয়ার সুযোগ আমরা দেখছি না। এ প্রকল্পগুলোর ঋণ টাকায় না, আমাদের ডলারে শোধ করতে হবে। আমরা বিনিয়োগ না আনতে পারি, ডলার না আনতে পারি তাহলে অবশ্যই বড় ঝুঁকি আছে।’
মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ উঠতে লাগবে ৪৫ বছর : বিগত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর একটি মেট্রোরেল। গত বছর পূর্ণ উদ্যমে চালু হয় মেট্রোরেল লাইন-৬। যদিও এ প্রকল্পের কমলাপুর অংশের কাজ এখনো চলমান। জুলাই শেষে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৩৮ শতাংশ। মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা হলেও দুবার সংশোধনীর পর মাত্র দেড় কিলোমিটার বাড়ানোর পর এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, পুরোদমে চালু হলে মেট্রোরেলে দিনে ৫ লাখ যাত্রী চলাচল করবেন। তখন মাসে ৭২০-৭৩০ কোটি টাকা আয় হবে। সেই হিসাবে দাম না বাড়ালে শুধু টিকিট বিক্রির আয় দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের খরচ উঠে আসতে কমপক্ষে ৪৫ বছর লাগবে। জাপানের ঋণে হওয়া এ প্রকল্পটির লাভ তো দূরে থাক, এখন বিনিয়োগ তুলে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া গত জুলাইয়ে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। ফলে ওই দুই স্টেশনের খরচ টিকিট বিক্রির লাভ আসবে না এক বছরেও।
মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য পাঁচটি আলাদা চুক্তির মাধ্যমে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। গত বছরের মে মাসে মাশুল, সুদ, আসলসহ প্রথম কিস্তির ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় কিস্তির সুদ-আসল বাবদ ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর দুটি কিস্তিতে এভাবেই আগামী ৩০ বছর ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ঋণচুক্তির গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ নেওয়া ও পরিশোধ শুরুর মাঝখানের বিরতি) শেষ হবে আরো তিন বছর পরে। প্রথম ঋণচুক্তির কিস্তির মতো তখনো বছরে দুটি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। এভাবে ২০৩১-৩২ অর্থবছর থেকে পঞ্চম ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ওই বছর পাঁচটি ঋণচুক্তির জন্য একসঙ্গে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিস্তির পরিমাণও বাড়বে বলে জানা গেছে। ২০৬১-৬২ অর্থবছরে মেট্রোরেলের সব ঋণ পরিশোধ হবে।
কর্ণফুলী টানেলে দৈনিক আয় ১২ লাখ, ব্যয় ৩৭ লাখ : আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় প্রকল্প চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল। অর্থনৈতিক করিডোরের কথা চিন্তা করে এ প্রকল্প নেওয়া হলেও সেখানে বিনিয়োগের তেমন দেখা নেই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের কথা ছিল তার সিকি ভাগও সেখানে চলছে না। টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলছে না। ফলে টোল আদায় কম হচ্ছে। আয়ের চেয়ে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় এখন পর্যন্ত বেশি।
সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত দিনে গড়ে সাড়ে ৪ হাজারের কিছু বেশি যানবাহন চলাচল করেছে। পূর্বাভাস ছিল, এর অন্তত চারগুণ যানবাহন চলবে। টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যদিকে এই টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে ব্যয় গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটি দেশের নদীর তলদেশের প্রথম টানেল। চীনা ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ টানেল তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এখনো আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো যদি যাতায়াতের করিডোর হিসেবে থেকে যায়, তাহলে অবশ্যই বড় শঙ্কার ব্যাপার ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে। এ প্রকল্পগুলো যাতায়াত করিডোর থেকে অবশ্যই অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক করিডোর করতে হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। সেখানে শিল্প-কারখানা ভারী কারখানা আমরা সুপরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা যদি সময়মতো না নিতে পারি, সেখানে বড় ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এত বড় বিনিয়োগ শুধু যাতায়াতের করিডোর হওয়ার সুযোগ আমরা দেখছি না। এ প্রকল্পগুলোর ঋণ টাকায় না, আমাদের ডলারে শোধ করতে হবে। আমরা বিনিয়োগ না আনতে পারি, ডলার না আনতে পারি তাহলে অবশ্যই বড় ঝুঁকি আছে।’
হাদিউজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল করা হয়েছে মিরসরাই ও মাতারবাড়ীর মতো অর্থনৈতিক করিডোরগুলো মাথায় রেখে। এগুলো যদি সঠিক সময়ে চালু না করতে পারি, তাহলে এ বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে।