গাজী শাহনেওয়াজ
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে তৎপর ইসি

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়ে হঠাৎ আলোচনায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলে দলটিকে নির্বাচনে আনতে এই চিঠি বলে দাবি দলটির। কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের আলোকে দলটিকে এ চিঠি দেননি তারা। এর আগে কমিশন বসে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে এ আহ্বান জানিয়েছেন তারা। অথচ বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতার আগে এই কমিশন হুঙ্কার দিয়ে বলে এসেছে, কেউ স্বেচ্ছায় না এলে আমন্ত্রণ জানিয়ে কাউকে নির্বাচনে আনতে বাধ্য করা হবে না।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এমন বক্তব্য সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রায়ই বলেছেন। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, কাউকে ধরে-বেঁধে নির্বাচনে আনবে না কমিশন। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তার এই বক্তব্য দেশের সব জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি কমিশন থেকে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে দলগুলোর নিজেদের উদ্যোগে বসে সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে। গত কয়েক মাস এমন আলোচনার মধ্যে গত ২৩ মার্চ সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে কৌশলী চিঠি পাঠায় ইসি। এ নিয়ে দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহল থেকে উঠে সমালোচনার ঝড়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একাধিক নির্বাচন কমিশনার এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে মতামত দিতে বিএনপিকে ইসি যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেটি আকস্মিক নয় বলে দাবি করেছেন কমিশনার মো. আহসান হাবিব। তিনি বলেন, বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে হয়নি। কমিশন সার্বিকভাবে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগেও বিএনপিকে একাধিকবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সিইসির দেওয়া চিঠিতে দলীয় অন্য নেতা এবং প্রয়োজনে সমমনা দলগুলোর নেতাসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়। চিঠিতে সিইসি লিখেছেন, ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন করে আসছি। আপনাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেও কমিশন মনে করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক না হোক, অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা বা মতবিনিময় হতে পারে। আপনাদের নির্বাচন কমিশনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সদয় সম্মত হলে দিনক্ষণ আলোচনা করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রত্যুত্তর প্রত্যাশা করছি। ইসির এই চিঠি পেয়ে কিছুটা হতবাক হয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইসির সঙ্গে আলোচনায় যাবে না বিএনপি। মহাসচিব বলেন, আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার, নির্বাচন কমিশনের কোনো আলোচনায় আমরা যাব না। কারণ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। ২৫ মার্চ আরেকটি সমাবেশে অংশ নিয়ে দলটির মহাসচিব আরো বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে রাজনৈতিক দলকে সংলাপের চিঠি দেওয়া সরকারের নতুন কৌশল। আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে নতুন খেলায় নেমেছে। মুখে গণতন্ত্র ও ভোটের কথা বলবে আর প্রশাসনকে যেভাবে বলবে সেভাবে চলবে। আবারও একই পাঁয়তারা করছে, পশ্চিমা বিশ্ব আগের মতো নির্বাচন চায় না।
এদিকে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আনুষ্ঠানিক কোনো সংলাপে না বসার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল ইসির। তবে, কোনো দল চাইলে, ভোটের আগের দিন পর্যন্ত তাদের জন্য আলোচনার দরজা খোলা থাকবে। তবে সব শর্ত ভুলে এক তরফা বিএনপিকে চিঠি দিয়ে যখন কঠোর সমালোচনার মুখে। ঠিক এই সময়ে নতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। এখন ভোল পাল্টে বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দলগুলোকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানাতে ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি শুরু করেছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হতে পারে। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের এই উদ্যোগের পেছনে ভিন্ন কোনো কৌশল নেই। অন্যতম একটি বড় দল হিসেবে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মনোভাব জানার তাগিদ থেকেই তাদের সঙ্গে কমিশন মতবিনিময় করতে চাইছে। একই সঙ্গে বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলোর বক্তব্যও জানা প্রয়োজন বলে কমিশন উপলব্ধি করছে। সে কারণে ওই দলগুলোকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তিনি জানান, এই আমন্ত্রণে বিএনপির শরিকরা দলগতভাবে কমিশনের আলোচনায় অংশ নিতে পারে। আবার চাইলে তারা জোটগতভাবেও যেতে পারে। এমনকি অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হতে পারে। নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য সব পথ খোলা রাখার কথা বলছে।
বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের কারণে সরকারের ইঙ্গিতে ইসি এখন আলোচনার কথা বলছে। তারা মনে করছেন, সরকার এবং ইসি দেখাতে চাইছে যে বারবার আলোচনায় আমন্ত্রণ করা হলেও বিএনপি আসছে না। অর্থাৎ বিরোধী দল আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী নয়। আর এ ধরনের কৌশল নিয়ে সরকার এবং কমিশন দায় এড়াতে চাইছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখনো যার যার অবস্থানে অনড়। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী, তথা বর্তমান সরকারের অধীনেই ভোট হবে বলছে। এই বিরোধ নিয়ে ইসির করার কিছু নেই। যার কারণে বিএনপি নেতারা ইসির সঙ্গে আলোচনাকে ‘অর্থহীন’ বলে আসছেন। এর আগে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল ইসি। তখন ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। ওই সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ ১২টি দল। রাজনৈতিক সমস্যা যা-ই থাক না কেন, ইসির ব্যাপারে বিএনপি এবং দলটির আন্দোলন সঙ্গীদের আস্থার অভাব রয়েছে। ইসি এখন পর্যন্ত আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পারেনি বলা যায়। বর্তমান ইসি এক বছরের বেশি সময়ে সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার যেসব নির্বাচন করেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্ন রয়েছে।
পিডিএসও/এমএ