গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৭ মার্চ, ২০২৩

সরকারের গলার কাঁটা বিজেসি

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ পাট করপোরেশন (বিজেসি) যেন সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। কারণ না পারছে ঢেলে সাজাতে, না পারছে বিলুপ্তির ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে। এই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকা সম্পত্তি নিয়ে জটিলতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, লোকসান থেকে বাঁচাতে ১৯৯৩ সালে বিজেসিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ৩০ বছর পার হয়েছে। এখনো বিলুপ্ত হয়নি। আবার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিজেসির মোট জমির পরিমাণ ২৯৫ একর। এর মধ্যে ১৯০ একরই বেদখলে। অর্থাৎ করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ১০৫ একর জমি। এরপর বছর পেরিয়ে গেলেও বেদখল জমির এক ছটাকও উদ্ধার হয়নি। আবার নিয়ন্ত্রণে থাকা জমি বিক্রি করে অর্থ রাষ্ট্রীয় কষাগারে জমা দেওয়ার চিন্তা থাকলেও তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ নিয়ে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সবকিছুই সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সংসদীয় কমিটির। এর আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় সম্পত্তি বিক্রি না করে সব সম্পত্তি বার্ষিক ভিত্তিতে ভাড়ার আওতায় আনার নির্দেশনা দেন। অথচ এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকা ১০৫ একর সম্পত্তির মধ্যে ৭০ একরের মতো সম্পত্তি ভাড়ার আওতায় আনতে পেরেছে করপোরেশনটি।

কর্মকর্তারা জানান, সরকার কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে জমি পেতে সমস্যায় পড়ে। জমি কিনতে গিয়ে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়। অনেক সময় জমি পাওয়াও যায় না। মূলত এসব দিক বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী বিজেসির সম্পত্তি বিক্রি না করতে নির্দেশনা দেন। তবে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিজেসির অবৈধ দখলে থাকা জমি বিক্রি করে টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো জানান, সারা দেশের সাতটি অঞ্চলে জমি রয়েছে বিজেসির। এর মধ্যে ছয় অঞ্চলের জমিই বেদখল হয়েছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫৩ একরের মধ্যে প্রায় ২৫ একর, রংপুরে ১৭৫ একরের মধ্যে ১২৯ একর, খুলনার ৩১ একরের মধ্যে ১৯ একর, নারায়ণগঞ্জে ২০ একরের মধ্যে ১৫ একর, নরসিংদীর দশমিক ৪৩ একরের পুরোটাই এবং হবিগঞ্জের ১ একরের মধ্যে পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ১৩ একরের পুরোটাই বিজেসির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অর্থাৎ বিজেসির মোট জমির পরিমাণ ছিল ৬৮৫ একর।

সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যই বিজেসি বিলুপ্ত করা হয়েছিল উল্লেখ করে বিজেসি চেয়ারম্যান তসলিমা কানিজ নাহিদা বলেন, সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আমরা এখনো পাইনি। তা ছাড়া জমি বিক্রি করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর নতুন করে নির্দেশনাও লাগবে। অথচ বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির আরেকটি সভা হয়েছে। সভার কার্যবিবরণির ৯.১ অনুচ্ছেদে বিজেসির মহাপরিচালকের একটা বক্তব্য পাওয়া গেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ১৯৯৩ সালে বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও আজও সেটা হয়নি। এমনকি এই সংস্থার বিভিন্ন নির্দেশনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। মোট ২৪৪ জন জনবলের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ছয়জন জনবল রয়েছে। দখলি সম্পত্তির মধ্যেও অনেকে মামলা মোকদ্দমা করে তাদের পক্ষে দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রথমদিকে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে এই জমি অন্য কোনো সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। কেবিনেটের আরেকটি নির্দেশনা ছিল- বিজেসি যে জমি দখলে রাখতে পারবে না; সমস্যা আছে সেগুলো জেলা প্রশাসকদের সরকারি খাস জমি হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করার। এর আলোকে প্রায় ৪০ একর তফসিলভুক্ত জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়েই কোনো অগ্রগতি নেই।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি মির্জা আজম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিজেসির দখলে থাকা ১০৫ একর জমি যেগুলো নিষ্কণ্টক ও কাগজপত্র ঠিক আছে সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার-সংক্ষেপ পাঠিয়ে অনুমোদন সাপেক্ষে বিক্রয় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা নিয়ে আসার সুপারিশ করা হয়েছে। আর যেগুলো বিজেসির দখলে নেই সেগুলোর কাগজপত্র ঠিক করে সরকারি বিধিবিধান মোতাবেক খাস করে ডিসিদের কাছে হস্তান্তর করার সুপারিশ করেছি।

তিনি আরো বলেন, বিজেসির বিলুপ্তির ৩০ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো একটা বিশাল অফিস এবং মাত্র ছয়জন জনবল টিকে আছে। আর প্রক্রিয়াগুলো যথাযথভাবে শেষ করতে পারলেই বিজেসির বিলুপ্ত সম্পূর্ণভাবে শেষ করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, বিজেসির কাজ ছিল সারা দেশের কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা পাট সংগ্রহ করে তা বিদেশে রপ্তানি করা। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা থেকে জাহাজে করে পাট চীন, পাকিস্তান, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেত।

জাতীয় সংসদে বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণার দিন সেখানে উপস্থিত একজন কর্মচারীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, বিজেসি বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর পাট খাতই রসাতলে চলে যায়। বিলুপ্তির ফলে পাট খাত থেকে বিদেশি আয় কমে যায় এবং কৃষকও দাম না পেয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেন। ওই কর্মচারী বলেন, তখন বিশ্বব্যাংকের একটা চাপ ছিল বিজেসি বন্ধ করার। কিন্তু সরকার বন্ধ না করলে কিছু হতো না। কোনো সরকার বিজেসির প্রতি সুবিচার করেনি, যার জন্য পাট খাত আর দাঁড়াতে পারেনি। এ খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সরকারের গলার কাঁটা বিজেসি,গলার কাঁটা বিজেসি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close