গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৮ মার্চ, ২০২৩

তদারকির অভাবে একের পর এক বিস্ফোরণ

ছবি : সংগৃহীত

তদারকি না থাকায় প্রায়ই ঘটছে বিস্ফোরণের ঘটনা। এতে নিহত হচ্ছেন মানুষ। আহতের সংখ্যাও কম নয়। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেকেই বরণ করে নিচ্ছেন পঙ্গুত্ব। সমাধানের উপায় খুঁজে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় ঘটছে বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এর মধ্যে অন্যতম কারণ সাতটি। কারণসমূহ হচ্ছে এসি থেকে বিস্ফোরণ, গ্যাস লাইনের লিকেজের কারণে দাহ্য বস্তুর সংস্পর্শে দুর্ঘটনা, পানির ট্যাংকিতে জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণ, সেপটিক ট্যাংকিতে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ, বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ থেকে দুর্ঘটনা, পুরোনো ও নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে দুর্ঘটনা, পয়োনিষ্কাশনের জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ এবং শিল্প-কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্প-কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা আগে বেশি ঘটত। গত বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে নিট টেক্স চিটাগং লিমিটেড নামে পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে দুজন আহত হন। এ কারখানায় প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করতেন। গত ৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অন্তিম নিটিং ডাইং অ্যান্ড ফিনিশিং লিমিটেড রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সুইং সেকশনের একটি ফ্লোরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর হয়। বছর না ঘুরতেই শনিবার (৪ মার্চ) বিকেলে সেই সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন-গ্যাস উৎপাদন কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হলেন ছয়জন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে ওইদিন ভোরে রাজধানীর গুলশানে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হন দুজন। তাদের মধ্যে গোপাল মল্লিক নামের একজনের মৃত্যু হয়। রবিবার (৫ মার্চ) আবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ভবনে বিস্ফোরণে মারা গেলেন তিনজন। মঙ্গলবার (৬ মার্চ) রাজধানীর গুলিস্তানে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাশাপাশি দুটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি ভবন সাততলা, আরেকটি পাঁচতলা। এর মধ্যে সাততলা ভবনের বেজমেন্ট, প্রথম ও দোতলা বিধ্বস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। পরপর তিনটি ঘটনায় ৩০ জন মারা গেলেন আর আহত হয়েছেন অনেকে। এমন ঘটনা বারবার ঘটলেও এর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এর আগেও অনেক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। ওই বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক ভবন কেঁপে ওঠে। গ্যাসলাইন লিকেজ থেকে ওই বিস্ফোরণ হয় বলে তদন্তসংশি¬ষ্টদের ভাষ্য। এর আগে গ্যাসলাইন লিক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে নারায়ণগঞ্জে। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩১ জন প্রাণ হারান। গত ২ ফেব্রুয়ারি ভাটারায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হয়। গত ডিসেম্বরে মিরপুরে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে আরিয়ান নামে ১৪ বছরের এক কিশোর মারা যায়। ১২ জানুয়ারি সাভারে সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে সাদিয়া নামে সাত বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

তা ছাড়া গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ব্রয়লার মুরগির খামারে বায়োগ্যাসের ট্যাংকি বিস্ফোরণে জুবায়ের নামের এক যুবক নিহত হন। ১৮ অক্টোবর যশোরের অভয়নগরে সেমি অটোরাইস মিলের বয়লার বিস্ফোরণে এক শ্রমিক নিহত হন। ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগের বউবাজার এলাকায় মেট্রো এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিস ডিপোতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। ৭ আগস্ট রাজধানীর তুরাগ থানার রাজাবাড়ী এলাকায় রিকশার গ্যারেজে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে দগ্ধ মো. আলম নামের একজন মারা যান। ১৫ অক্টোবর রাজধানীর শ্যামপুরের জুরাইন কবরস্থান রোডে তিতাস গ্যাসের লাইনে কাজ করার সময় বিস্ফোরণে পাঁচ শ্রমিক দগ্ধ হন। ১১ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে সড়ক কার্পেটিংয়ের সময় বিটুমিনের ড্রাম বিস্ফোরণে তিন শ্রমিক দগ্ধ হন।

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানা এলাকায় একটি বাড়িতে বিস্ফোরণে আটজন আহত হন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরখানের রাজাবাড়ী এলাকায় গ্যাসের চুলার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে তিনজন দগ্ধ হন। ২৫ অক্টোবর মানিকগঞ্জ পৌর এলাকায় গ্যাসের লাইন চালু থাকায় দেশলাই জ্বালাতেই বিস্ফোরণে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন দগ্ধ হন। এসব আলোচিত ও বড় ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটছে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। চোখ ও অঙ্গ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভুক্তভোগীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিস্ফোরক আইন ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন দাহ্যপদার্থ রাখা ছাড়াও এসব দুর্ঘটনার বড় একটি অংশ পুরোনো গ্যাসলাইন লিকেজ ও এসি থেকে হচ্ছে। মেকানিকদের অদক্ষতায় অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা বলছেন, গ্যাসের লিকেজ ও এসি-ফ্রিজের ছোটখাটো ত্রুটি সারাতে অনেকেই মেকানিক ডেকে আনেন। মেকানিকদের সঠিক কারিগরি জ্ঞান না থাকার কারণে বেশির ভাগ সময়ই মেরামতের পরও ত্রুটি থেকে যায়, যে কারণে এসব জায়গায় বারবার বিস্ফোরণ ঘটে। তা ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন প্রতিনিয়ত পরীক্ষা না করার করাণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতার ওপর জোর দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর এ কে শাকিল নওয়াজ বলেন, টাকা বাঁচাতে গিয়ে কোনো সময় মানসম্মত নয়, এমন পণ্য বা সিলিন্ডার কেনে মানুষ, যা ঠিক না। ৫০ টাকা ১০০ টাকার কারণে টোক খাওয়া, লেবেল ক্ষয়ে গেছে এমন বোতল কিনে আমরা পরিবার ও নিজেকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছি।

সায়েন্স ল্যাব এলাকায় জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে দাবি করেছে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। তারা বলছে, কোনো আবদ্ধ জায়গায় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অধিক মাত্রায় গ্যাস থাকলে বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্টসার্কিট, দেশলাই কিংবা লাইটার থেকে যেকোনো কিছু থেকেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশন থেকেও গ্যাস জমে। এটি পয়োনিষ্কাশন থেকে পাইপের মাধ্যমে ওপরে উঠে কোনো স্থানে জমতে পারে। এটি থেকে পরে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

রাজধানীতে বিস্ফোরণের ঘটনা বারবার কেন ঘটছে এ বিষয়ে কথা বলেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেছেন, দেখভালের দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল তাদের গাফিলতি ছিল। এসব ঘটনার দায় কার, সেটা খুঁজে বের করতে হবে তদন্ত করে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আরো সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এদিকে, এসি বিস্ফোরণের ঘটনা কেন ঘটে এ বিষয়ে মেজর এ কে শাকিল নওয়াজ বলেন, এর মূলে সাতটি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পুরোনো বা নিম্নমানের এসির ব্যবহার, রুমের আকার অনুযায়ী সঠিক ক্ষমতার এসি ব্যবহার না করা, কম্প্রেশারের ভেতরে ময়লা আটকে জ্যাম তৈরি হওয়া, এসি থেকে গ্যাস লিক হয়ে রুমে বা এসির ভেতরে জমে থাকা, দীর্ঘক্ষণ এসি চালানোর ফলে প্রেশার বেড়ে সেটিকে গরম করে তোলে, এসির ভেতরের বা বাইরের বৈদ্যুতিক তার নড়বড়ে হয়ে থাকে ও অনেক দিন এসির সার্ভিসিং না করানো।

করণীয় কী এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ভবন নির্মাণ করার সময় কোড মেনে করা। সবার আগে প্রয়োজন একটি নির্ভরযোগ্য নকশা প্রণয়ন করা। কোথায় কোথায় লিকেজ হচ্ছে তা খুঁজে বের করা। আর ঝুঁকি কমানো আমাদের প্রথম কাজ। এটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এটা নিয়মিত করে যেতে হবে। তাহলেই অনভিপ্রেত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরও গাইডলাইন দিতে পারে। গ্যাস লিকেজের কারণে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে এতে ভয়াবহতা বেশি ছড়ায়। এজন্য প্রতিনিয়ত গ্যাসলাইনে তদারকি দরকার। বিশেষ করে অবৈধ লাইন বন্ধ করা জরুরি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের এ দুর্ঘটনা রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারা প্রশিক্ষণ দেবেন ও কারা নেবেন তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, উন্নত বিভিন্ন দেশে মেকানিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের নিবন্ধন থাকে। নিবন্ধিত মেকানিকের বাইরে কেউ কাজ করাতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় যার যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়েই মেরামত করিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস একটা ভালো কাজ করেছে। সেটা হচ্ছে আরবান কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবী (ভলান্টিয়ার) তৈরি করেছে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে পরিকল্পনা ছিল দুজন নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই সংগঠনের সদস্য কাজ করবে। ওয়ার্ড কমিশনাররা চাইলেই তাদের কাজে লাগাতে পারেন। তাহলে দুর্ঘটনার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার বিষয়টি অনেক ফলপ্রসূ হবে। এই টিমের কাজ হবে ভূমিকম্প ও বা অগ্নিকাণ্ড থেকে মানুষকে রক্ষা করা।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তদারকির অভাব,বিস্ফোরণ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close