নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিএনএ ল্যাবে ১২ শতাংশ নমুনা পিতৃত্ব বিরোধের
ডিএনএ ল্যাবে ৮ বছরে আসা মামলার আলামতের ১২ শতাংশ পিতৃত্ব বিরোধসংক্রান্ত। এ হিসাবে ২ হাজার ৯০টি মামলা এসেছে পিতৃত্ব বিরোধের। এ তথ্য জানিয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের মামলার অধিকাংশ ভুক্তভোগী ধর্ষণের শিকার হয়ে সন্তানের মা হয়েছেন। তাদের একটা বড় অংশ আবার শিশু।
আগুনে পুড়ে অঙ্গার লাশেরও পরিচয় ডিএনএ ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় জানতে পারছেন স্বজনেরা। ২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৫১ জনের লাশ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। দেখে চেনার উপায় ছিল না কোন লাশটি কার। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সিআইডি ৫১টি লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেছে। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনে অঙ্গার হওয়া ৩২ লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পাশাপাশি পচা-গলা লাশ এবং অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তেও ডিএনএ পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গত ৮ বছরে সিআইডি ৪ হাজার ৫২৯টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করেছে ডিএনএ পরীক্ষাগারে।
অবশ্য ডিএনএ পরীক্ষাগারের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানান সিআইডির কর্মকর্তারা। এর মধ্যে কিট, রাসায়নিক ও কনজ্যুমেবল সামগ্রীর সংকট রয়েছে। পরীক্ষাগারে জায়গাসংকটের পাশাপাশি আছে জনবলসংকট। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব ছাড়া ডিএনএ ব্যাংকের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা রয়েছে।
অপরাধী শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়ছে। অজ্ঞাত লাশের পাশাপাশি পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হচ্ছে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, ডিএনএ হচ্ছে একজন ব্যক্তির বংশগতির মৌলিক উপাদান। ১৯৭৭ সালের কথা। ঢাকার একটি এতিমখানা থেকে পাঁচ বছর বয়সী কুলসুম ও তার তিন বছর বয়সী বোন সুমিকে দত্তক নেন সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি। এরপর দুই বোনের ঠিকানা হয় সুইজারল্যান্ডে। সেখানে কুলসুম এখন ম্যারিও সিমো ভ্যার্মো নামে পরিচিত। বিয়েও করেছেন সুইস নাগরিককে, হয়েছেন মা। তবে ৪৫ বছর পর ম্যারিও সিমো ভ্যার্মো নিজের শিকড়ের সন্ধান শুরু করেন।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর গত বছরের এপ্রিলে মা মাফিয়া বেগমকে খুঁজে পান ম্যারিও। মায়ের কাছে ফিরেছিলেন তিনি। তবে মাফিয়া ও ম্যারিও যে সম্পর্কে মা-মেয়ে, সেটি নিশ্চিত হতে প্রয়োজন পড়েছে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার। তাদের ডিএনএ প্রোফাইল বিশে¬ষণ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষজ্ঞরা মা-মেয়ের একত্র হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ ঘটনাকে সাম্প্রতিক সময়ে সিআইডির উলে¬খযোগ্য অর্জনগুলোর অন্যতম বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন মামলার বায়োলজিক্যাল আলামত থেকে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করছে সিআইডির ডিএনএ ল্যাবরেটরি। অপরাধী শনাক্তে সাহায্য করাই এ ল্যাবের মূল কাজ। সূত্রবিহীন (ক্লুলেস) হত্যার ঘটনায় হত্যাকারী শনাক্ত হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার সূত্র ধরেই। অজ্ঞাত লাশের পাশাপাশি পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হচ্ছে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে।
সিআইডি বলছে, ২০১৪ সালে ডিএনএ ল্যাব স্থাপনের পর গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪২৩টি মামলার আলামত গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ১৬৬টি মামলার ডিএনএ প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে মতামত দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধ প্রমাণে ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়ার কারণে ল্যাবে মামলার আলামতের সংখ্যা বাড়ছেই। প্রতিষ্ঠার প্রথম বছর ডিএনএ ল্যাবে ২০৫টি মামলার আলামত হিসেবে ডিএনএ নমুনা আসে। ২০২২ সালে (অক্টোবর পর্যন্ত) ৫ হাজার ১৬৮ মামলায় ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের অনুরোধ আসে। অর্থাৎ ৮ বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা বেড়েছে ২৫ গুণের বেশি।
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ইমাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত ও অপরাধের সঙ্গে সন্দেহভাজন ব্যক্তির সম্পৃক্ততা শনাক্ত করতে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করে তা বিশে¬ষণ করা হয়। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব নির্ণয়েও ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা এবং আদালতে অপরাধ প্রমাণে ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।