মিজান রহমান

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

প্রশাসকমুক্ত হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

সাড়ে পাঁচ বছর পর দেশের সব জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে প্রশাসকমুক্ত হতে যাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কাউন্সিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অথবা মার্চে এই সংগঠনের নির্বাচন করতে চায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনকে এ ধরনের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত প্রস্তুতির জন্য ফেব্রুয়ারিতে এই নির্বাচন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ২৩ মার্চের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলাপর্যায়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলাপর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সংগঠনটির নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে পৃথক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, জেলাপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট অনেক ডিসি এবং উপজেলাপর্যায়ে ইউএনওরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বয়সে নবীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলতেও তারা আগ্রহী নন। এ নিয়ে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় নির্বাচন আয়োজনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে তাগিদ দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৮ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কমিশনের অন্যান্য সদস্য হলেন শাহজাহান সিদ্দিকী বীর-বিক্রম (গত ২৪ নভেম্বরে মারা গেছেন), অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. আনছার আলী খান, লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এ এফ এম ইয়াহিয়া চৌধুরী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান পরিষদ সচিবের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি একটি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে মার্চে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের নির্বাচন করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় চাইছে, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ভোটার তালিকা (মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত তালিকা), প্রতীক ও অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কার্যালয় ভবনে নিজেদের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করেছে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের বিদায়ি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বীর-বিক্রম। ২০১৭ সালের ৮ জুন তার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পরিচালনায় নির্বাচিত কমিটির (২০১৪) মেয়াদ শেষ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ১৯ জুলাই কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে পৃথক প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন হওয়াটা জরুরি। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। চূড়ান্ত ভোটার তালিকাসহ যেসব আইনগত জটিলতা ছিল তা দূর হয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব আমরা নির্বাচন করতে চাই। এজন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্বাচন করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনই নেবে। প্রধানমন্ত্রী এই কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। আশা করছি, নির্বাচন কমিশন বসে শিগগিরই ভোটের তারিখ ঘোষণা করবে।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বীর-বিক্রম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আদর্শের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণার্থে সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল। স্ব^াধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধারাই এর নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, এ সংগঠনটি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে সরকারি আমলা অর্থাৎ প্রশাসক দিয়ে চলছে।

তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্বে না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির অতন্দ্র প্রহরী। তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ রক্ষার লড়াইয়ে সম্পৃক্ত করতে হবে।

জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে ২০১৭ সালে হেলাল মোর্শেদ খানের নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে। তার কমিটির মেয়াদই ৫ বছর করার জন্য প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন। বিষয়টি অনুমোদনের জন্য পরে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলেও (জামুকা) পাঠায় কেন্দ্রীয় কমান্ড কমিটি। কিন্তু এভাবে নির্বাচিত কমিটি তাদের নিজেদের মেয়াদ বাড়াতে পারে কি না, তা নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে মন্ত্রণালয় ও জামুকায় অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিটও করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে সংসদের মেয়াদ ৫ বছর করার জন্য একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয় তৎকালীন কার্যনির্বাহী কমিটি। ২০০১ সালে প্রণীত গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক। এতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্ব নিয়ে দেশব্যাপী অচলাবস্থা তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রশাসক নিয়োগের নিয়োগের আদেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয় থেকে একই বছরের ১৯ জুলাই সংসদ পরিচালনার জন্য পৃথক প্রশাসক নিয়োগের অফিস আদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড, ৭টি মহানগর কমান্ড, ৬৪টি জেলা ও ৪৭০টি উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল রয়েছে। যার নেতৃত্বে এখন ডিসি ও ইউএনওরা।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রশাসকমুক্ত,মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close