reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩

পেশাদারিত্বের ঘাটতি দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা

জঙ্গি ছিনতাই : শামীম-সোহেলের হদিস নেই, সালেহীনও অধরা

ছবি : সংগৃহীত

ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জেএমবির শীর্ষ তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়াদের একজন সালাউদ্দিন সালেহীন পলাতক ৯ বছর ধরে; সবশেষ ঢাকায় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির হদিসও দুই মাসে মেলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের এসব ঘটনায় বাহিনীর ‘পেশাদারিত্বের ঘাটতিকে’ কারণ মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এসব ঘটনা সমাজে সংঘটিত অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তুলবে। পালানো জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে নিজেদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও তাতে অগ্রগতি সূচক কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শুরা সদস্য ছিলেন সালেহীন। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায়ও রয়েছেন তিনি।

বলা হচ্ছে, এই সালেহীনই ত্রিশালে পুলিশ ভ্যান থেকে পালানো আরেক জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজানকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে জেএমবির নতুন শাখা খুলেছেন, যার নাম তারা দিয়েছেন জামায়াতুল মুজাহিদিন ইনডিয়া-জেএমআই।

বিহারের বুদ্ধ গয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের মামলার আসামি বোমা মিজান গত ৬ অগাস্ট বেঙ্গালুরুতে এনআইএর এক অভিযানে ধরা পড়েন। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দারাও এখনো সালেহীনের সন্ধান পাননি।

২০১৪ সালের ওই ঘটনার পর গত বছরের ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত এলাকায় ‘পুলিশের মুখে স্প্রে মেরে’ ছিনতাই করা হয় জাগৃতী প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃতুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাকে। তাদেরও ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক ওই ঘটনার পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়; একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ফেরানো হয় আসামিদের হাতে-পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানোর রীতি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত ফসকে এভাবে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় তাদের ‘পেশাদারিত্বের ঘাটতির’ কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমোনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান। তিনি বলেন, অনেক বলেছি, আসলে বলার তেমন কিছু নাই। আসামি ধরার পড়ে এভাবে যদি চলে যায়। যদিও দেখছি, আমাদের এখানে জঙ্গি দমনে সাফল্য অনেক আছে আর জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছে। তবে একটি জায়গা আমরা খুব নরমালি চলি, এখানে পেশাদারিত্বের ঘটতি আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে এভাবে চলে যেতে পারে, এটার একটি জেনারেল প্রভাব তো সমাজের মধ্যে আছেই।

জিয়া রহমানের মতে, এখানে আরেকটি জিনিস অনুপস্থিত। তা হলো সাজা হোক আর না হোক, তাকে সংশোধনের সুযোগ করে দেওয়া। এভাবে পালিয়ে গেলে তার মধ্যে তো দ্বিগুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। আর ধরা না পড়লে তো তরুণ সমাজের মধ্যে তো এর একটি প্রভাব পড়বেই। আর অর্গানাইজড ক্রাইম করার প্রবণতা আরো বেড়ে যায়।

নিরাপত্তা-বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুুর রশিদ বলেন, আমি মনে করি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সারা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখলে যে ধরনের উদাহরণ পাই, তা হলো জঙ্গিবিরোধী অভিযানে শতভাগ সাকসেস অপারেশন হবে সেটা আশা করা যায় না। অভিযানে সফলতা ও বিফলতা দুটিই থাকবে। একটি ও দুটি ঘটনার সফলতা ও বিফলতায় আমরা মাত্রাকে ওজন করতে চাচ্ছি যে, কোনটার মাত্রা বেশি সফলতা না বিফলতা। সেই হিসেবে হলি আর্টিসানের পর যে একটি ঘটনা ঘটল-আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া, এটি একটি বিফলতা। এ ঘটনা জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে পরিবর্তন করে না এবং শঙ্কাও তৈরি করে না।

আবদুুর রশিদ বলেন, এখন প্রশ্ন হলো এই বিফলতার পেছনে যে কারণগুলো আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গিরা নিজেদের সফলতা দেখিয়ে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেও বিফলতার মাত্রা এখনো ‘উদ্বেগজনক পর্যায়ে যায়নি’। এভাবে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিদের একটি কৌশলমাত্র। তাই আমি মনে করি না এটা সামনে শঙ্কা তৈরি করবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে আবদুুর রশিদ বলেন, জঙ্গিদের টার্গেট থাকে তরুণসমাজকে একটি আইডোলজি তৈরি করে তাদের র‌্যাডিকালাইজ করা এবং ঘর ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করা। তবে ঘরছাড়া তরুণের যে হার, সেটি উদ্বেগ সৃষ্টির পর্যায়ে যায়নি। যত দিন জঙ্গিবাদের ধারণা বেঁচে থাকবে, তত দিন এ ধরনের ঘটনা কিছু হলেও থাকবে।

আদালত চত্বর থেকে পালানো দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের অগ্রগতি জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা আছে। দেখা যাক, আশা করছি তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব। তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, তারা দেশেই কোথাও আত্মগোপনে রয়েছে।

তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এদিকে দেশের জঙ্গিবাদ এবং মানুষের মনন থেকে এর ধারণা দূরে রাখতে সমাজ ও পারিবারিক ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুুর রশিদ। তিনি বলেন, সশস্ত্র জঙ্গিবাদ দমন করার দায়িত্ব আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, আর মস্তিষ্কে যে জঙ্গিবাদ বাস করে, তা দমন করার দায়িত্ব আমাদের সমাজের-অভিভাবকের, বাবা-মা ও স্বজনদের। সমাজের সক্রিয়তার কারণে হলি আর্টিসানের ঘটনার পর জঙ্গিবাদের প্রসার সংকুচিত হয়েছে। সমাজ, বাবা-মা ও শিক্ষককে আরো সচেতন হতে হবে। জঙ্গিবাদ ছড়ানোর পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা কাজ করে। এই পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে আলাদা করতে হবে।

জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দেশে সক্রিয় রয়েছে মন্তব্য করে আবদুুর রশিদ বলেন, আমাদের জঙ্গিবাদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো জঙ্গিবাদের জন্ম ও উত্থান থেকে শুরু করে বা বেড়ে ওঠার সময় কিছু হয় আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে ঘিরে। আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই হচ্ছে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়ার একটি মাধ্যম। সেখানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। পক্ষান্তরে তারা হয়তো জঙ্গিবাদকে সহায়তা করে অথবা সুরক্ষা দেয়। জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করা উচিত, তাহলে জঙ্গিবাদের প্রসার ঠেকানো সম্ভব। তবে এ দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার যে গতিতে আছে, সেটি শঙ্কা তৈরি করার পর্যায়ে যায়নি, স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জঙ্গি ছিনতাই
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close