reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

একটি ব্রেন ডেথ থেকে ৮ জীবন রক্ষা সম্ভব

সারাহ ইসলাম (বামে), অধ্যাপক ডাক্তার হাবিবুর রহমান (ডানে)। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

অধ্যাপক ডাক্তার হাবিবুর রহমান একজন ইউরোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন। সম্প্রতি দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী সারাহ ইসলাম নামের ২০ বছর বয়সি মেয়েটি তার কিডনি ও কর্নিয়া দান করে যান। সারাহ ইসলামের মস্তিষ্কের মৃত্যু (ব্রেন ডেথ) হওয়ার পর তার কিডনি দুজন রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। তার কর্নিয়াও দেওয়া হয় দুজন চক্ষু রোগীকে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন হওয়া এই চারজন রোগীই ভালো আছেন।

সারাহ ইসলামের কিডনি প্রতিস্থাপনকারী চিকিৎসক দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইউরোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান। এই ঐতিহাসিক কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ২১ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সারাহ ইসলামের স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন ডা. হাবিবুর রহমান। সারাহর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিষয়ে বক্তব্যে তিনি বলেন, একজন মানুষ যদি দান করে যান অথবা তার স্বজনরা যদি রাজি হন, তাহলে ব্রেন ডেথ অবস্থায় রোগীর দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া যায়। একজন ব্রেন ডেথ মানুষের দেওয়া অঙ্গগুলোর মাধ্যমে আটজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। দুটি কিডনি, দুটি ফুসফুস, একটি হৃদযন্ত্র, একটি অগ্ন্যাশয়, পূর্ণাঙ্গ অন্ত্রনালি ও যকৃৎ। এটা একটা বিশাল ব্যাপার।

তিনি বলেন, অঙ্গের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ৩০ বছর ধরে আমরা ব্রেন ডেথ রোগীর কাছ থেকে অঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু কোনোভাবেই সফল হতে পারছিলাম না। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়রা রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। ফলে আমাদের চিকিৎসকদের উদ্যোগ আর সফল হতে পারেনি। সারাহ ইসলামের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে একটি নবদিগন্তের সূচনা হলো।

অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান আরো বলেন, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মানুষ যখন অন্তিম পর্যায়ে চলে যায়, তখন একসময় তার মস্তিষ্ক মারা যায় (ব্রেন ডেথ)। মস্তিষ্ক তখন আর কোনো কাজ করে না। সে সময় কৃত্রিমভাবে রোগীর হৃৎপিন্ড ও ফুসফুস সচল রাখা হয়। যখনই এটি খুলে নেওয়া হয় তখনই সেই রোগী মারা যায়। এমন উদাহরণও আছে যে, ১০ বছর পর্যন্ত ব্রেন ডেথ অবস্থায় রাখা হয়েছে। ব্রেন ডেথের ঘোষণা যখন দেওয়া হয়, তখন অনেকে কৃত্রিম ব্যবস্থা খুলে নিতে বলেন। কেউ কেউ আবার বলেন, হৃৎপিন্ড কাজ করছে, ফুসফুস কাজ করছে, মানুষটা তো জীবিত, তাহলে কেন খুলে নেওয়া হবে? আসলে এটা সম্পূর্ণ আবেগের ব্যাপার।

সারাহ ইসলাম দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে ভুগছিলেন। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ২০ বছর বয়সি মেয়েটি ১৯ বছরই কষ্ট ভোগ করেছেন। পাঁচ বছর আগে তার রোগ চরম পর্যায়ে চলে যায়। পাঁচটি বছর ধরে মস্তিষ্ক তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচরের জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর আমরা যখন বুঝতে পারি, শি ইজ গোয়িং টু বি এ ব্রেন ডেথ পেশেন্ট, সারাহর মাকে আমরা বিষয়টা বলি। অঙ্গদানের বিষয়টি বললে তিনি খুবই ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসেন। আমাদের বলেন, তাকে নাকি সারাহ বলেছেন, ‘মা আমার যদি মৃত্যু হয়ে যায়, তুমি আমার সবকিছু দান করে দেবে। এমনকি যদি সুযোগ থাকে, আমার ব্রেনটা নিয়েও একটা অ্যানালাইসিস করবা।’

সারাহর মায়ের কথা শুনে আমরা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এ রকম সিদ্ধান্ত সবাই নিতে পারেন না। নিজের সন্তান, কষ্টের ধনকে কি কেউ কাটাছেঁড়া করতে দেবেন? বেশির ভাগ মানুষ দেন না। সারাহর মায়ের মতো যার হৃদয় বিশাল কেবল তিনি এমনটি পারেন। সারাহর মায়ের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে আমরা অঙ্গ সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। এই অস্ত্রোপচার অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। চাইলে সবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায় না। অঙ্গগ্রহীতার সঙ্গে ম্যাচ করতে হয়। এটাকে বলে ক্রস ম্যাচ। প্রায় ১৫০ জনের একটা দল অস্ত্রোপচারের জন্য তৈরি। সবাই অপেক্ষা করছি। ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা সময় একটা প্রতিষ্ঠান থেকে ইতিবাচক খবর এলো ঠিক কিন্তু ক্রস ম্যাচের যে ফলাফল জানা গেল তা আশানুরূপ নয়। আমরা হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। আরেকটা প্রতিষ্ঠানকে বললাম, তোমাদের রেজাল্ট কী? তারা বলল, ৯টার দিকে জানাতে পারবে। প্রতিটি প্রহর, প্রতিটি মুহূর্ত আমরা ক্ষণগণনা করেছি। অপারেশন থিয়েটারসহ সব প্রস্তুত। ৯টা ১ মিনিটে মুঠোফোনে কল এলো, দুজন কিডনি রোগী পাওয়া গেছে যাদের ক্রস ম্যাচ ফলাফল আশানুরূপ। তাদের দেহে এই কিডনি প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। রাত সাড়ে ৯টায় আমরা অপারেশনের প্রস্তুতি নিলাম। সারাহার মা সম্মতিপত্রে সই করলেন।

একজন অঙ্গগ্রহীতাকে বিএসএমএমইউতে এনে প্রস্তুত করা হলো। আরেকজন রোগীকে আমরা ভর্তি করি কিডনি ফাউন্ডেশনে। তাকেও প্রস্তুত করা হয়। সেই দলের নেতৃত্বে থাকেন অধ্যাপক ডাক্তার খুরশীদুল আলম। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান কাজ ছিল অপারেশন করে সারাহর কিডনি দুটি সংগ্রহ করা। জটিল একটা কাজ। আমার জীবনে প্রথম এমন অস্ত্রোপচার। এ ঘটনা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। আগে হাজার হাজার অপারেশন করেছি। কখনো এভাবে আবেগপ্রবণ হইনি। একটা বাচ্চা মেয়ে, সোনার মতো খাঁটি একটা মেয়ে, এভাবে তার অঙ্গগুলো দিয়ে যাচ্ছেন। তার চেয়ে কত বড় বড় মানুষ, কিছুই দিলেন না। পুরো অপারেশনে আমি একটা আচ্ছন্নের মধ্যে ছিলাম।

চিকিৎসক দলে আমরা অনেকেই ছিলাম যারা অনেক অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছি। কিন্তু সেটা ছিল জীবিত মানুষের কাছ থেকে নেওয়া কিডনি। কিন্তু সারাহর কিডনি নেওয়া হয়েছে তাকে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার পর। আমার তাত্ত্বিক জ্ঞান আছে; দক্ষ লোকজন আছে। অপারেশন শেষ করার পর আমার মনে হয়েছে, এই অপারেশন যেন আমি অনেকবার করেছি। কিডনি নিয়ে আমরা প্রসেস করলাম। এই অংশটুকুও আমার কাছে একদম নতুন। তবু আমার মনে হয়েছে যেন আমি এক্সপার্ট, অনেকবার করেছি। তখন আমার মনে হয়েছে, এই যে মেয়েটা দান করে গেছেন মানুষের জন্য, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে কবুল করেছেন। একটা স্বর্গীয় ব্যাপার এখানে আছে, না হলে আমার মধ্যে এ রকম উদ্যম কেন আসবে।

প্রক্রিয়া শেষ করে একটি কিডনি পাঠানো হলো কিডনি ফাউন্ডেশনে। আমি দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে চলে গেলাম এবং সফল হলাম। এত ভালো অপারেশন হবে কল্পনাও করিনি।

পরদিন সারাহর দুটো কর্নিয়া সংগ্রহ করে আমাদের কর্নিয়া টিম। সেটার একটা অপারেশন হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেকটা সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে। যাদের এই কর্নিয়া দেওয়া হয়েছে তারা দুজনই ভালো আছেন।

দীর্ঘদিন ধরে যে কাজটি আমরা করার চেষ্টা করছিলাম, দুরূহ সেই কাজ কত সহজে করে দিয়ে গেলেন সারাহ। শুধু সারাহর ঘটনার কারণে আরো দুজন ব্রেন ডেথ রোগী এখন তৈরি হয়ে গেছেন, যেকোনো মুহূর্তে আমরা সম্মতি পেতে পারি। সামনের দিনগুলোতে বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রচারে নামব। সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং তারকাদের নিয়ে আমরা ওয়ার্কশপ করব। একটা গণকর্মসূচিতে যাব আমরা। অঙ্গদান নিয়ে মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার, এভাবে সেটা দূর হয়ে যাবে। বলা যায়, সারাহ আমাদের এমন পথ দেখিয়ে গেছেন, যেখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ আর নেই।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ব্রেন ডেথ,জীবন রক্ষা সম্ভব
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close