reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩

দেশে ৬০ ভাগ প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলের শিক্ষা বঞ্চিত: জরিপ

পটুয়াখালীর গলাচিপার ফাল্গুনি সাহার ইচ্ছে শক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে। ছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের অর্ধেকের বেশি কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পায় না বলে ইউনিসেফ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে উঠে এসেছে। জরিপ বলছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের (৫-১৭ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ৩৫% শিশু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নথিভুক্ত আছে। ফলে মোট ৬০% প্রতিবন্ধী শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে, তাদের বয়স অনুযায়ী অন্য শিশুদের তুলনায় তারা শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশে এই প্রথম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে জরিপ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় আইন থাকার পরেও কেন এত শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাচ্ছে না? বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে সেই কারণ।

‘স্কুলে গিয়ে কেমন করে পড়বে? বরিশালের হাসি আক্তারের ছোট মেয়ে জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। তিনি তাকে আর স্কুলে পড়াশোনা করতে পাঠাননি। এখন মেয়েটির বয়স হয়েছে ১৫ বছর। তিনি বলছিলেন, ‘ও স্কুলে গিয়ে কেমন করে পড়বে আর পড়ে কী করবে? ও তো চোখেই দেখতে পায় না। তার ওপর ওকে কে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে। বরং ঘরের কাজ শিখলে লাভ হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো ও ইউনিসেফের এই গবেষণা বলছে, এরকম চিন্তা-ভাবনা থেকে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেননি। প্রতিবন্ধিতা উন্নয়ন বিষয়ক পরামর্শক নাফিসুর রহমান বলেছেন, ‘একটা সময় বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী সন্তানদের বাবা-মা মনে করতেন, তাদের সন্তানরা স্কুলে গিয়ে কী করবে? অনেক সময় তারা প্রতিবন্ধী সন্তানদের পরিচয়ও দিতে চাইতেন না। এখনো কারো কারো মধ্যে সেই মনোভাব আছে। যদিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, স্কুলগুলো প্রতিবন্ধী শিশুদের নেয়ার জন্য কতটা প্রস্তুত?’

গবেষক নাফিসুর রহমান আরও বলছে, স্কুলে এই শিশুদের জন্য সুযোগ সুবিধার অনেক অভাব আছে। যেমন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ লাগে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য ব্রেইল লাগে। এগুলোর অভাব আছে। আবার অনেক স্কুলে প্রতিবন্ধী শিশু নিতে চাইলেও অন্যান্য অভিভাবকরা নানারকম চাপ তৈরি করেন।

‘আইন আছে, সুযোগ নেই’

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে একটি আইন করা হয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ সকল প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তির অন্য সব নাগরিকের মতো সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন, আইন থাকলেও বাস্তবে সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ঢাকার বাসিন্দা কুলছুম আক্তারের বড় ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। স্থানীয় একটি স্কুলে বয়সের তুলনায় ছোট ক্লাসে তিনি ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু সেখানে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আপত্তির কারণে সন্তানকে নিয়ে আসতে হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট একটি স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এখন বাসায় একজন টিউটর রেখে আর নিজে গাইড করে ছেলেকে নিয়মকানুন শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘আমার ছেলে হয়তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে না, সেই আশাও আমি করি না। অন্তত নিজের কাজ যেন সে করতে পারে, সেভাবে তাকে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করছি। সেটা পারলেই আমরা খুশি।’

অভিভাবকরা বলছেন, বাংলাদেশে আইন ও সরকারি নানান উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়নি। বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই তাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকে না। গণপরিবহনের যাতায়াতে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাথরুম তাদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। এমনকি সহপাঠী ও শিক্ষকদেরও প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে আচরণে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে সব ক্ষেত্রেই তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।

প্রতিবন্ধিতা উন্নয়ন বিষয়ক পরামর্শক নাফিসুর রহমান বলছেন, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নীতিমালার দিক থেকে বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সেটার বাস্তবায়নের জায়গায় অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তার মতে, ‘আমাার দেশে একটা আইন আছে যে, বাধ্যতামূলকভাবে প্রাতিটি শিশুকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু সেখানেও একটা ফাঁক রয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, এই কথা বলে অনেক সময় শিক্ষকরা প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করতে চায় না। এটা খানিকটা সত্যিও। কারণ শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব আছে। যদিও আস্তে আস্তে স্কুলগুলোর অ্যাটিচুডের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কাঙ্খিত পরিবর্তন এখনো হয়নি।’

জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে ইউনিসেফ একটি বিবৃতি বলেছে, এই শিশুদের জন্য আরও অনেক কিছু করার দরকার আছে। বিশেষ করে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সেবা দিতে হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা উন্নতি করতে পারবে।

পিডিএস/এইচএস

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পটুয়াখালী,গলাচিপা,ফাল্গুনি সাহা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close