টিআইএনধারী বেড়েছে, রিটার্ন জমায় অনাগ্রহ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার হার বাড়ছে না। এ বছরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার হার প্রত্যাশিত পর্যায়ে না হওয়ায় সময়সীমা এক মাস বাড়ানো হয়েছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, রিটার্ন জমা দেয়ার হার এখনো পর্যন্ত গত বছরের চাইতে বেশি। তারপরও সরকার আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, রিটার্ন জমার হার সে প্রত্যাশা এখনো পূরণ করতে পারেনি। গতকাল বিবিসি এ তথ্য জানায়।
২০২১ সালের ২৯শে নভেম্বরে রিটার্ন জমা দেওয়া নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু এ বছর পয়লা জুলাই থেকে ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ২২ লাখ মানুষ। প্রতি বছর ৩০শে নভেম্বর আয়কর দিবস হিসেবে পালন করা হয় বাংলাদেশে, এবং সাধারণত এই দিনটিই থাকে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার শেষ দিন। যদিও প্রতি বছরই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনুরোধে রিটার্ন জমা দেয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়ে থাকে। এ বছরও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে, বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর বিভাগের সদস্য শাহীন আক্তার। তিনি বলেছেন, আগের অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রিটার্ন জমা দেয়ার হার বেড়েছে। ২০২১ সালের ২৯ শে নভেম্বরে রিটার্ন জমা দেয়া নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৫০ হাজার।
কিন্তু এ বছর পয়লা জুলাই থেকে ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ২২ লাখ মানুষ।
শাহীন আক্তার বলেছেন, যেহেতু সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, নির্ধারিত তারিখে রিটার্ন জমার সংখ্যা ও হার বাড়বে বলে তারা আশা করছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এই মূহুর্তে দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বা ই-টিআইনধারী মানুষের সংখ্যা ৮২ লাখ।
আয়কর আইন অনুযায়ী, টিআইএন নম্বর থাকার অর্থ হচ্ছে, একজন নাগরিক কর দেবার উপযুক্ত হোন কিংবা না হোন, অর্থবছর শেষে তার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাজস্ব বোর্ডে জমা দিতে হবে, যাকে আয়কর রিটার্ন বলা হয়। এক্ষেত্রে ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির আয়ব্যয়ের হিসাব চিহ্নিত করা হয় যে নম্বর দিয়ে সেটাই তার কর শনাক্তকরণ নম্বর বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা টিআইএন। একজন করদাতা অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমেও এই নম্বর পেতে পারেন, সেটি হবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, যা ই-টিআইএন নামে পরিচিত। এবং আইন অনুযায়ী করযোগ্য আয় না থাকলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে এক কোটি টাকার ওপর আয় আছে, এমন পরিবারের ৬৭ শতাংশই আয়কর দেন না।
কেন রিটার্ন দেয় কম মানুষ? বাংলাদেশে সাধারণভাবে করযোগ্য আয় আছে এমন সকল নাগরিককে আয়কর দিতে হবে, এমন বিধান আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আয়কর দেন না দেশের একটি বড় অংশের মানুষ।
২০১৭ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টর ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে এক কোটি টাকার ওপর আয় আছে, এমন পরিবারের ৬৭ শতাংশই আয়কর দেন না। এবং এই আয়কর না দেয়া পরিবার কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়, দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছেন সেই মানুষেরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী এই মূহুর্তে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, পরিবার, অংশীদারি ফার্ম, সংগঠনের বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার বেশি হলে তাকে আয়কর দিতে হবে। নারী এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকের জন্য এ সীমা তিন লাখ টাকা, অর্থাৎ তিন লাখ টাকার বেশি আয় হলে তাদের আয়কর দিতে হবে। প্রতিবন্ধী করদাতার জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা পৌনে চার লাখ টাকা।
রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকার প্রতি বছরই নানা উদ্যোগের কথা বললেও এখনো ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর দেয়া মানুষের সংখ্যা এক কোটির নিচে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিআইএন গ্রহণের হার অনেক বেড়েছে। ২০২২ সালে দেশে টিআইএন নম্বরধারী নাগরিকের সংখ্যা ৮২ লাখ, ২০২০ সালেও এ সংখ্যা ছিল ৪০ লাখের কিছু বেশি। কিন্তু সে তুলনায় রিটার্ন জমা দেয়া মানুষের সংখ্যা সমানভাবে বাড়েনি।
আয়কর বিভাগের সদস্য শাহীন আক্তার মনে করেন, তিনটি কারণে এটি হয়- প্রথমত, মানুষের মধ্যে রিটার্ন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, কিছুদিন আগে পর্যন্ত রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না, সেটি আরেকটি কারণ। এছাড়া মানুষের মধ্যে আয়কর দেওয়া বা রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহও আছে। এর বাইরে আগে করযোগ্য আয় ছিল, কিন্তু চলতি বছরে ‘সোর্স অব ইনকাম’ বা আয়ের উৎস কমে গেছে অথবা নেই হয়ে গেছে, এমন ক্ষেত্রেও অনেকে রিটার্ন জমা দিতে চান না। কিন্তু এর ফলে পরবর্তীতে তিনি যে ঝামেলায় পড়তে পারেন, সেটি সম্পর্কে জানেন না অনেকেই।
তবে আক্তার বলেছেন, এ বছর রিটার্ন জমা দেয়ার হার বাড়ার একটি কারণ হচ্ছে চলতি বছরে এ সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত নিয়ম ছিল ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে টিআইএন নম্বর প্রদান করা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এ বছরের জাতীয় বাজেটে বিধান করা হয়েছে, ৩৮ ধরনের সরকারি সেবা গ্রহণে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক, অর্থাৎ রিটার্ন জমার সাম্প্রতিক প্রমাণ না দেখালে সেবা বঞ্চিত হবেন একজন নাগরিক।
সিপিডির একজন পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, আয়কর দাখিলের প্রক্রিয়াটি সহজ করা হলে এক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ আরো বাড়ত। এছাড়া এখন যে এক পাতার অনলাইন ফর্ম আছে সেটিও ৪ ডিসেম্বর রবিবার থেকে জাতীয় বোর্ডের ওয়েবসাইটে ই-টিআইএন অংশে দেওয়া থাকবে, যা ডাউনলোড করে সহজেই একজন রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
পিডিএসও/এমএ