নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৬ নভেম্বর, ২০২২

দমছেই না এডিস মশা 

ছবি : সংগৃহীত

এডিস মশা বাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরের বিস্তার এখন সারাদেশেই। এডিস মশা দমনে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। ফলে এডিস নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি নতুন উপায় খুঁজছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। তবে চলতি বছর যত মৃত্যু হয়েছে, তা আগে হয়নি। এবার যত সময় ধরে এর প্রকোপ চলছে, তাও দেখা যায়নি আগে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে দেশের ৬২ জেলায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রতিবছর যেখানে নভেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে, সেখানে এ বছর নভেম্বরের ২৫ দিনে ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, এ বছর অন্তত পাঁচটি কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রাকৃতিক, বাকি দুটি সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক। তিন প্রাকৃতিক কারণের ক্ষেত্রে কারো হাত ছিল না। তবে দুই ক্ষেত্রে সঠিক সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ অনেকটাই সম্ভব হতো বলছেন তারা।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, এ বছরের ডেঙ্গু এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। ডেঙ্গুকে নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। এখন এটি শুধু মৌসুমি কোনো রোগ নয়, আবার ঢাকাকেন্দ্রিকও নয়। তাই এর প্রতিরোধে চিরাচরিত পদ্ধতি পাল্টে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গত ২২ বছরের ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতা হলো, আগাম বৃষ্টি হলে ডেঙ্গু একটু আগে শুরু হয়। শেষ হয় তাড়াতাড়ি। আবার দেরিতে বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি আরও বাড়ে। তবে কম-বেশি অভিজ্ঞতা হলো, বৃষ্টির মৌসুমে অর্থাৎ জুন থেকে প্রকোপ বাড়তে থাকে। আর তা সেপ্টেম্বরের দিকে কমে আসে। কিন্তু এ বছর মধ্য নভেম্বর পার হলো, মৃত্যু কমছে না। শনাক্ত সপ্তাহখানেক ধরে একটু কম হলেও আগের যেকোনো বছরের চেয়ে তা বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওলবাকিয়া নামে ব্যাকটেরিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা এনে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছেন তারা। অপরদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় নিয়ে গবেষণা দরকার। প্রয়োজনে তিনি গবেষকদের অর্থায়ন করতে রাজি আছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানান, এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ওলবাকিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা পালন ও এ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট ও জিওলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সঙ্গে দূদফা বৈঠক করেছেন। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের টিম বাংলাদেশে আমাদের উত্তর সিটির একটা অংশে ওলবাকিয়া পদ্ধতির ওপরে একটা পাইলটিং করতে চাচ্ছে। আমরা রাজি হয়েছি।

এ পদ্ধতি সম্পর্কে জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘এটা পুরুষ মশাকে জম্মদানে অক্ষম করার করার পদ্ধতি। ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া যখন প্রকৃতিতে ছাড়া হবে, তখন মূলত স্ত্রী এসিড মশার সঙ্গে মিলিত হবে, যারা ডেঙ্গু ছড়ায়। এ মিলনে ফলের স্ত্রীর আর বাচ্চা উৎপাদন হবে না। ফলে আস্তে আস্তে স্ত্রী মশাগুলো যখন মারা যাবে, তখন ডেঙ্গু একেবারে কমে যাবে।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখছি। কীটপতঙ্গের বা এডিস মশার বিবর্তনের পরিবর্তন দেখছি এবং সময়সীমার পরিবর্তন দেখছি। এ বিষয়ে আমাদের পূর্বাভাস পাওয়া প্রয়োজন। আপনার লক্ষ্য করছেন যে, এবার এডিস মশার প্রাদুর্ভাব অক্টোবর ছাড়িয়ে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় চলমান রয়েছে। এখন কার্তিক মাসের শেষ। এতদিন এডিস মশার প্রাদুর্ভাব থাকার কথা ছিল না। এখন আমরা শুষ্ক মৌসুমে চলে এসেছি। কিন্তু তারপরও আমরা এডিস মশার বিস্তার লক্ষ্য করছি।’

মেয়র জানান, মৌসুমের পরেও এডিস এবং মৌসুমের আগে কিউলেক্স মশার বিস্তার হওয়ার কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের আরও কার্যকর গবেষণা দরকার।

তাপস বলেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সেজন্য যদি কোনও বরাদ্দ প্রয়োজন হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তা দিতেও প্রস্তুত আছে। কারণ, আমরা ঢাকাবাসীকে মশক নিয়ন্ত্রণের সুফল পৌঁছে দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’

দুই সিটির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘গবেষণা করা সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। তাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় সহযোগিতা করা, যেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। তবে নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো বিষয়। ওলবাকিয়া পদ্ধতি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। দেশে যেকোনো একটি ছোট জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আর একটি বিষয় হচ্ছে ওলবাকিয়া ইনফেক্টেট মশা বাংলাদেশে না এনে, দেশীয় গবেষকদের নিয়ে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে দেশীয় মশায় এ ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে প্রকৃতিতে ছাড়া যেতে পারে। তাতে ভালো ফল আসবে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দমন হচ্ছেই না,এডিস মশা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close