নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

জলাতঙ্ক : মৃত্যু আর নয়, সবার সঙ্গে সমন্বয়

* আক্রান্ত শিশুকে স্কুলে পাঠানো যাবে না * থাকতে হবে সাবধানে

বিশ্ব জলাতঙ্ক বা র‌্যাবিস দিবস বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। ২০০৭ সাল থেকেই বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশসহ এশিয়ার ২২ দেশে এই দিবস পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি পালিত হচ্ছে এ দেশে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘র‌্যাবিস : ওয়ান হেলথ জিরো ডেথস’; যার বাংলা ভাবানুবাদ ‘জলাতঙ্ক : মৃত্যু আর নয়, সবার সঙ্গে সমন্বয়’। এ প্রতিপাদ্যে প্রধানত জলাতঙ্ক, মৃত্যু ও সমন্বয়—এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর র‌্যাবিস কন্ট্রোল তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দপ্তর থেকে এ দিবস পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে। র‌্যাবিস বা জলাতঙ্ক হচ্ছে ভাইরাস গঠিত একটি রোগ; যা সাধারণত কুকুর, শেয়াল, বাদুর প্রভৃতি উষ্ণরক্তের প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। এটি এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীতে পরিবাহিত হতে পারে তার লালার মাধ্যমে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রাণীর মধ্যেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। প্রতি বছর বিশ্বে যত মানুষ কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার ৯৯ শতাংশই এই রোগের কারণে হয়। বর্তমানে বিশ্বে বছরে ৫৯,০০০ মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ১৮৮৪ সালে জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এ মহাবিজ্ঞানী। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘বিশ্ব জলাতঙ্ক’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি পালনের লক্ষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী এই রোগের প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি। এ রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর ১২টি দেশের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে ২০০৭ সালে প্রথম বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপিত হয়।

বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসকে সামনে রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতি বছরের মতো এ বছরও দেশজুড়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, মুক্ত আলোচনা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রহণ করা হয়েছে।

জলাতঙ্কের সমাধান, সঠিক সময়ে টিকাদান আসুন সবাই মিলে কাজ করি, জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করি : জলাতঙ্ক প্রাচীনতম সংক্রামক রোগের একটি। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পানিভীতি, আলোভীতি, বায়ুভীতি হলেও এর শেষ পরিণতি মৃত্যু। তবে এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। যদি কোনো প্রাণী বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি, শিয়াল কামড় বা আঁচড় দেয় সঙ্গে সঙ্গে সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান ১৫ মিনিট ধৌত করে যথাসময়ে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংগঠনের পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে জলাতঙ্কে মৃত্যুহার শূন্যে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ সরকারের নানান স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ কমে এসেছে। জুনোটিক ডিডিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ৩০০টির অধিক জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাস্থ মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যার হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই কেন্দ্রগুলোতে কুকুর বা অন্যান্য প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী আরআইজি প্রদান করা হচ্ছে। সরকার প্রতি বছর তিন লাখের অধিক জলাতঙ্ক সংক্রমণকারী প্রাণীর কামড় ও আঁচড়ের রোগীকে বিনা মূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করছে। এর ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের গাইড লাইন অনুসারে বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ (তিনটি ০, ৩ ও ৭ দিনে) এক সপ্তাহে দেওয়ার ফলে রোগীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এর পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণীদেহে জলাতঙ্কের জীবাণু ল্যাবে নিশ্চিতকরণের কাজ করে চলেছে। এতে করে নির্দিষ্ট স্থানে এ রোগের উপস্থিতি ও প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করে মানুষ ও প্রাণীদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপকহারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে এরই মধ্যে ৬৪টি জেলায় ১ম রাউন্ড, ১৭টি জেলায় ২য় রাউন্ড এবং ৬টি জেলায় ৩য় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২২ লাখ ৫১ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে, যা মানুষ ও প্রাণীদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, বিভিন্ন দিবস পালন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, স্কুল প্রোগ্রাম, জনবার্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস সামনে রেখে দেশজুড়ে আলোচনা সভা, র‌্যালি, সেমিনারসহ নানান কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়েছে।

‘মুজিববর্ষে স্বাস্থ্য খাত, এগিয়ে যাবে অনেক ধাপ’ স্লোগান সামনে রেখে জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগাম কর্তৃক গৃহীত সব যুগোপযোগী কার্যক্রমের মাধ্যমে জলাতঙ্ক নির্র্মূলে এগিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২০২২ সফলভাবে উদযাপনের মাধ্যমে দেশকে জলাতঙ্ক মুক্তকরণে সবার সার্বিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জলাতঙ্ক,র‌্যাবিস দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close