মিজান রহমান
গ্যাসের চাহিদা মিটবে নিজস্ব উৎপাদনেই
উত্তোলনে গুরুত্ব দিতে হবে যথাযথ প্রক্রিয়ায়
গ্যাসক্ষেত্রগুলোর ওপর গবেষণা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উত্তোলন করা গেলে নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমেই শতভাগ গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বর্তমানে নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা থেকে চাহিদার ৭৫ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। এটিকে দ্বিগুণ করার মাধ্যমে শুধু সক্ষমতা নয়, ঘাটতিও মেটানো যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্যই জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের রিজার্ভার ইঞ্জিনিয়ার ও বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা বর্তমানে দৈনিক চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে নিজস্ব উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে জোগান দেওয়া হচ্ছে মাত্র তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এতে বিদেশ থেকে অনেক টাকায় গ্যাস আমদানি করেও চাহিদা পূরণ যাচ্ছে না। বড় একটি অংশ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাসক্ষেত্রগুলোর ওপর গবেষণা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উত্তোলন করা গেলে, নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমেই শতভাগ গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বর্তমানে নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা থেকে চাহিদা পূরণের সক্ষমতার ৭৫ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। এটিকে দ্বিগুণ করার মাধ্যমে শুধু সক্ষমতা নয়, ঘাটতিও মেটানো যেতে পারে।
দেশে চাহিদার মধ্যে বাপেক্স ১০৫ মিলিয়ন, বিজিএফসিএল ৬৪০ মিলিয়ন আর সিলেট দিচ্ছে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এসব রাষ্ট্রীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে ৮১৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফিল্ডগুলো যেমন—শেভরন দিচ্ছে ১ হাজার ৪১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। নিজস্ব সক্ষমতার মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারলে দৈনিক চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভর হতে হবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়তি চাহিদা পূরণে গ্যাস উৎপাদনকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, একই সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকেও ঝুঁকছে দেশ। নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর দৌড়ে অনেকাংশেই পিছিয়ে দেশি কোম্পানিগুলো। মাত্র কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও দেশে গ্যাস উৎপাদনের পুরোটাই ছিল দেশি কোম্পানিগুলোর হাতে। কিন্তু দুই দশকের ব্যবধানে এ খাতের অর্ধেকেরও বেশি দখলে নিয়েছে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি। গ্যাস উৎপাদনে এই বিদেশনির্ভরতা নিকট ভবিষ্যতেই ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাই গ্যাস উৎপাদনে গুরুত্ব দিছে সরকার।
বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপগুলোতে রয়ে গেছে ৫০ শতাংশ গ্যাস : ড. আমিরুল ইসলাম তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনের যেসব কূপ বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’ করে ফের গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। কাতার, নরওয়ে বা মেক্সিকোর মতো বিশ্বের গ্যাস উৎপাদনকারী অনেক দেশই ‘প্রাইমারি রিকভারি’ শেষে ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’র মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে। বাংলাদেশের যেসব গ্যাসকূপ বন্ধ হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে ‘প্রাইমারি রিকভারি’র মাধ্যমে ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। বাকি অর্ধেক গ্যাস এখনো রয়ে গেছে। বিশ্বজুড়েই গবেষণা বলছে, প্রাথমিকপর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়। পরবর্তী আরো দুটি ধাপে উত্তোলন করলে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এ রকম কোনো চেষ্টা কখনো করেনি।
ডাউনহোল গ্যাস কমপ্রেশারের মাধ্যমে ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’ : গবেষণায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের যে ন্যাচারাল রিজার্ভার রয়েছে, অর্থাৎ আমরা যেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন করি, সেখানে কয়েকটি ধাপে করা হয়। যেমন : প্রাথমিক ধাপে রিজার্ভার প্রাকৃতিকভাবেই তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে গ্যাস ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। আমরা মূলত সে গ্যাসটাই পেয়েছি, যেটা রিজার্ভার নিজস্ব শক্তিতে আমাদের দিয়েছে। তার পরিমাণ হলো ৫০ শতাংশ। ধীরে ধীরে ওপরের দিকে ঠেলে দেওয়ার এ শক্তিটা কমে আসে বলেই সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস আমরা পাই। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে এই ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করেই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ সেখানে ‘প্রাইমারি রিকভারি’ ও ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’র মতো ধাপগুলোর দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল।
সেকেন্ডারি মেথডে বিশ্বের অনেক দেশ ডাউনহোল গ্যাস কমপ্রেশারের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য খুব বেশি সক্ষমতার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু এ ‘ডিভাইস’টি মাটির নিচে বসিয়ে দিলেই হয়ে যায়। এরপর ডিভাইসটিকে শুধু অপারেট করতে হয়।
আরো ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পারে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড : গবেষণায় বলা হয়, ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’র মাধ্যমে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পারে। এ ছাড়া বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডের চারটি কূপ বন্ধ রয়েছে। এ কূপগুলোতে প্রাথমিকভাবে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, মেঘনা, নরসিংদী গ্যাস ফিল্ড, সিলেট, কৈলাশটিলা, রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, শেমুতাং, সুন্দরপুর, শ্রীকাইল, বেগমগঞ্জ, রূপগঞ্জে যদি প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়ার্ক ওভার করে এবং ডিপ ড্রিলিংয়ে যায়, তবে উৎপাদন আরো বাড়বে।
এতে বলা হয়, আমাদের কোম্পানিগুলোর বর্তমানে পাঁচ হাজার মিটার পর্যন্ত খনন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সাত থেকে আট হাজার মিটার নিচেও গ্যাস রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। দেশের প্রতিটি গ্যাস ফিল্ড নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে, আমরা সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন করতে পারব। রাষ্ট্রীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকেই তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসতে পারে, সেটা টেকনিক্যালি সম্ভব।
নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান জরুরি : টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করতে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো রয়েছে, সেগুলো থেকে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। অফশোর গ্যাস ফিল্ডগুলোতে উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় ভারত ও মিয়ানমার অনেক বছর ধরে গ্যাস উৎপাদন করছে। আমরা এখনো অফশোর থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরুই করতে পারিনি। বর্তমানে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের যে সক্ষমতা, অফশোরে উত্তোলন সক্ষমতা বাড়াতে অর্থ বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। ম্যান, মেশিন, টেকনোলজি- এ তিনের সমন্বয় করতে হবে।
দক্ষ প্রকৌশলীর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে গবেষণায় জানানো হয়, নিজস্ব উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা পূরণে সর্বোচ্চ ১০ বছর সময় লাগবে। নিজস্ব গ্যাস ফিল্ডগুলোর উন্নয়ন করে ২০৩০ সালের মধ্যে নিজস্ব সক্ষমতায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের টার্গেট নিলে তখন অফশোর থেকেও গ্যাস উত্তোলনের তাগিদ আসবে। ২০৩০ থেকে ২০৪০ সাল সময়কালকে টার্গেটে নিলে সব মিলিয়ে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন সম্ভব।
এ বিষয়ে গবেষক ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বিদেশি বহুজাতিক শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচটি বৃহৎ গ্যাস ফিল্ড কিনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর দেশীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে সময় জাতির পিতার কেনা পাঁচটি বড় গ্যাস ফিল্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড অন্তর্ভুক্ত। দেশের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের নেওয়া সাহসী পদক্ষেপ পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন সক্ষমতা এত দিনে কয়েক গুণ বেশি থাকত।