হাসান ইমন ও আরমান ভূঁইয়া

  ১৮ জুলাই, ২০২১

পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি উধাও

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে (উত্তর ও দক্ষিণ) স্থায়ী দুটি হাটসহ ২০টি পশুর হাটে বিক্রি শুরু হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি হাটের গেটে ডিজিটাল ব্যানারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সিংহভাগই তা মানছে না। সিটি করপোরেশনের দেওয়া ৪৬টি শর্তের মধ্যে অধিকাংশই মানছেন না ইজারাদাররা। হাটের গেটে সুরক্ষাসামগ্রী থাকলেও ইজারাদারের লোকরা এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে সেসব ব্যবহারে অনীহা দেখা গেছে।

নগরীর পশুর হাটগুলোতে গতকাল দেখা গেছে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। তারা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ডেম কেয়ার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পশুর হাটগুলোতে বাস্তবে স্বাস্থ্যবিধি প্রায় কেউই মানছেন না। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি যেন উধাও হয়ে গেছে। শুধু রাজধানীই নয়, সারা দেশেই পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণই কারো মধ্যে দেখা যায়নি।

রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে গতকাল শনিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। চলবে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে কোরবানির জন্য আনা পশুতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়েছে হাটগুলো। প্রস্তুতির সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে ইজারা কর্তৃপক্ষ। গরু রাখা, হাসিল আদায়ের একাধিক কাউন্টার, নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প, স্বেচ্ছাসেবক, এমনকি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও লাগানো হয়েছে। কিন্তু করোনার এই চ্যালেঞ্জে দেখা মেলেনি স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের। বেশির ভাগ ব্যাপারীর মুখে মাস্ক নেই, নেই হ্যান্ডগ্লাভস-স্যানিটাইজার। গরুর পাশেই গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দেন ব্যাপারীরা।

হাট ইজারার ৪৬টি শর্তে মধ্যে রয়েছে পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের একমুখী চলাচল থাকা অর্থাৎ প্রবেশপথ এবং বহির্গমন পথ পৃথক করার কথা থাকলেও তেমন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। হাটের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও দু-একজন ছাড়া সবাই হাত না ধুয়েই প্রবেশ করছেন। তাপ মাপার যন্ত্র থাকলেও ইজারাদার লোকের পকেটে থাকছে। বৃদ্ধ ও শিশুদের পশুর হাটে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও হাটে প্রচুর শিশুর আনাগোনা দেখা গেছে। তবে তিনটি হাটে মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না ইজারা কর্তৃপক্ষ।

গতকাল রাজধানীর ৬টি হাট সরেজমিনে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে।

মেরাদিয়া হাট : পুরো হাট পশুতেই পরিপূর্ণ। পুরোদমে বিক্রি শুরু হলেও বড় গরু বিক্রি কম হচ্ছে। তবে মাঝারি ধরনের গরু ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে বেশি। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। তবে বিক্রেতাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা গেছে। অনেকের মুখে মাস্ক নেই। আবার কেউ থুতনিতে আটকে রেখেছেন। ইজারাদার কর্তৃপক্ষ সবাইকে মাস্ক পরতে উৎসাহ করলেও হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহারের কথা বলছে না। তাপ মাপার যন্ত্র থাকলেও মাঝেমধ্যে ব্যবহার করতে দেখা যায়। একমুখী চলাচলের কথা থাকলেও যার যার মতো চলতে দেখা গেছে। সিটি করপোরেশনের শর্তগুলোর অধিকাংশই মানতে দেখা যায়নি।

আশরাফ আলী ও মজনুসহ ছয়জন পাবনা থেকে যৌথভাবে ১৪টি মাঝারি সাইজের দেশীয় গরু এনেছেন। এসব গরু আনা হলেও গতকাল পর্যন্ত তিনটি গরু বিক্রি হয়েছে। তবে অনেকে দরদাম করে চলে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে ইজারাদার আওরঙ্গজেব টিটু প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে আমরা স্বাস্থ্যসুরক্ষার সবকিছুই ব্যবস্থা করেছি। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি। মাইকে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে।

একই অবস্থা আফতাবনগর হাটে। সেখানেও হাটের সব প্রস্তুতি থাকলেও ব্যাপারীদের মধ্যে মাস্ক পরতে অনীহা দেখা গেছে। তারা পাশেই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ থেকে নিজের খামারের আটটি মাঝারি সাইজের দেশীয় গরু এনেছেন মাইনুল ইসলাম। গতকাল পর্যন্ত বিক্রি হয়নি একটিও। তার মুখেও কোনো মাস্ক দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে ইজারাদার ওমর শরীফ দিপু প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মাইকে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছি। হাত ধোয়া ও মাস্ক পরতে সবাইকে বলা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুব কমসংখ্যক লোকই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।

উত্তরা-১৭ নম্বর সেক্টরে বৃন্দাবন হাট : প্রবেশ গেটে নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা কিংবা তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র। গেটে দায়িত্বরত হাট পরিচালনাকারী সদস্যদের মুখেও মাস্ক নেই। জানতে চাইলে মুকুল ও সজীব বলেন, প্রচণ্ড গরম। সারা দিন রাস্তায় ডিউটি করি। তাই মাস্ক ব্যবহার করা যায় না। ক্রেতাদের তাপমাত্রা নিশ্চিত ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে মুকুল বলেন, তাপমাত্রা মাপার মেশিন পকেটে আছে। কয়জনের দেখমু। যাকে সন্ধেহ হয়, তার তাপমাত্রা দেখি। হাটে পশু নিয়ে আসা সিংহভাগ খামারি বা ব্যাপারীর মুখে মাস্ক নেই। কোরবানির পশু কিনতে আসা অধিকাংশ ক্রেতার মুখেও মাস্ক নেই। ইতোমধ্যে বিশাল এ হাটে প্রায় ১৫ হাজার পশু এসেছে। জানতে চাইলে হাট ইজারাদার মো. নুর হোসেন বলেন, হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। আমরা ১০ হাজার মাস্ক বিতরণ করেছি। আরো ৫ হাজার মাস্ক বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া প্রতি কাউন্টারে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

মোহাম্মদপুর বসিলা পশুর হাট : এ হাটেও নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা কিংবা জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহারের ব্যবস্থা। নেই তাপমাত্রা মাপার মেশিন কিংবা মাস্ক নিশ্চিতের ব্যবস্থা। হাট পরিচালনা সদস্যের অধিকাংশ মুখেই মাস্ক নেই। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা খামারি কিংবা ব্যাপারীদের মুখে নেই কোনো মাস্ক। হাটে কোরবানির পশু নিয়ে আসা খামারিদের মাস্ক ও জীবাণুনাশক দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে পশু ব্যাপারী মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘প্রথমদিন মাস্ক দিছিল এরপর আর কিছুই দেয় নাই।’

গাবতলী পশুর হাট : এ হাটে কিছুটা স্বাস্থ্যবিধির ব্যবস্থা রাখা হলেও মানা হচ্ছে না। প্রবেশ গেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক রাখা আছে। গেটের ওপর অংশে জীবাণুনাশক স্প্রের ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োগ হচ্ছে না। তবে, এ হাটে ব্র্যাক ও বিকাশের ব্যবস্থাপনায় মাস্ক বিতরণ করতে দেখা গেছে। গাবতলী হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সব ধরনে ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে প্রচুর মানুষের ভিড়। একদিক দিয়ে কাজ করলে অন্যদিক দিয়ে মানুষ আসে। তাই হয়তো পুরোপুরি মানা যাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার পশু হাটে আসছে। এখনো বিভিন্ন জেলা থেকে পশু আসছে। এবারের বড় পশুগুলো প্রবেশ গেটের পাশেই রেখেছি। এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার একটি গরু বিক্রি হয়েছে।

এদিকে এবারে কোরবানির পশুর দাম বেশ চড়া বলে মনে করছেন পশু কিনতে আসা ক্রেতারা। উত্তরা বৃন্দাবন পশুর হাটে ছোট ও মাঝারি আকারে পশু বেশি। তবে, দাম খুব বেশি বলছেন ক্রেতারা। কোরবানির পশু কিনতে আসা আশিক বলেন, গতবার যে গরু ৫০ হাজার টাকা ছিল। এ বছর তা ৯০ হাজার চাইছেন খামারিরা। আরেক ক্রেতা আহসান উল্লাহ বলেন, গতবার আমি যে গরু কিনেছি ৭০ হাজার টাকায়, এ বছর তার দাম চাইছে এক দেড় লাখ টাকা।

গাবতলী হাটে এবারও ছোট গরুর সঙ্গে বিশাল আকৃতির অনেক পশু দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসব পশু আনা হয়েছে। একেকটি গরু প্রায় ৫ থেকে ৬ ফিট আকারের। লম্বায় প্রায় ১০ থেকে ১২ ফিট। আর প্রতিটি গরুর ওজন ২৮ থেকে ৪০ ওজনের। এগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ৮ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, কোরবানির পশুর হাটগুলোতে সরকারি নির্দেশনাসহ স্বাস্থ্যবিধিসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, জীবনের পশুর হাটগুলোতে সামাজিক দূরত্ব যথাযথভাবে বজায় রাখতে হবে, ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পশুর হাট,স্বাস্থ্যবিধি,কোরবানি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close