শ্যামল আতিক
আমার বাচ্চা খায় না
আমার বাচ্চা খেতে চায় না, খাবার ফেলে দৌড়াদৌড়ি করে, নিজে নিজে খেতে পারে না - বেশিরভাগ মা এ ধরনের অভিযোগগুলো করেন। এ নিয়ে মা-বাবাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা নেই বললেই চলে। যত সমস্যা সচ্ছল পরিবারে। যত দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই সমস্যা দ্রুত সর্বত্র সংক্রমিত হচ্ছে। অথচ কেন এ ধরনের সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি না।
প্রথম কারণ খাওয়ানোর ব্যাপারে অনিয়ম। আমরা শিশুকে আমাদের মতো করে খাওয়ানোর চেষ্টা করি। অধিকাংশ সময় ক্ষুধার্ত হওয়ার পূর্বেই খাবার নিয়ে তার পিছনে ছুটাছুটি করি। কিন্তু শিশুর কখন ক্ষুধা লাগে, তা বুঝার চেষ্টা করি না। শিশু তখনই খাবে যখন শিশুর ক্ষুধা লাগবে। আর ক্ষুধা লাগার বিষয়টি নির্ভর করে শিশুর খেলাধুলা ও দৌড়াঝাপের উপর। যেহেতু বেশিরভাগ শিশু বাসা থেকে বের হতে পারে না, তাদের পক্ষে খোলা মাঠে দৌড়াঝাপ ও খেলাধুলা করার সুযোগও কম। তাই ক্ষুধার মাত্রাও কম।
তার উপর যোগ হয়েছে জাঙ্ক ফুডের অনাচার। পরিবারের সদস্যরা শিশুকে সময়ে অসময়ে চিপস, বিস্কুট, চকোলেট, আইস্ক্রীম, ফাস্টফুড, চানাচুর ইত্যাদি মুখরোচক দিয়ে থাকেন। শিশুর পাকস্থলি খুব ছোট। স্বাভাবিক খাবারের আগে এই সব আবর্জনা দিয়ে পাকস্থলি ভরাট করার ফলে, শিশু আর স্বাভাবিক খাবার খেতে চায় না। এছাড়াও মুখরোচক খাবারে শিশু একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, অন্য খাবারে সে আর আগ্রহ দেখায় না।
অতি মনোযোগ আরেকটি কারণ। আগে পরিবারে একাধিক শিশু ছিল। সব শিশুকে মনোযোগ দিয়ে খাওয়ানো মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার উপর খাবারের ঘাটতি থাকায়, শিশুরাও খাবারের জন্যে অপেক্ষা করত। এখন বাচ্চার সংখ্যা এক অথবা দুই জন। আদরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী গৃহকর্মীসহ সবাই খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে জোরও করা হয়। প্রতিদিন তিন বেলা সবার কাছ থেকে এভাবে চাপাচাপির কারণে, শিশুর মধ্যে খাবারের প্রতি ভীতি বা বিরক্তি তৈরি হয়।
আবার শিশু মা-বাবার কাছ থেকে পর্যাপ্ত গুনগত সময় না পেলে, খাওয়া দাওয়া নিয়ে দুষ্টামি করতে পারে। অনেক মা অভিযোগ করেন- শিশু খাবারের সময় ছুটোছুটি করে, খাবার দিলে মুখের মধ্যে রেখে দেয়, খায় না আবার ফেলেও না। এসব আচরণের মাধ্যমে শিশু মূলত মা-বাবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। সে জানে, দ্রুত খেয়ে ফেললে আপনি তার প্রতি আর মনোযোগ দিবেন না। তাই এ ধরনের আচরণের মাধ্যমেই সে আপনার কাছ থেকে মনোযোগ আদায় করে নেয়।
প্রতিদিন একই খাবার খেলে শিশুর মধ্যে একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রেও এটা হয়। বিরিয়ানী আমাদের অনেকেরই পছন্দ, তাই বলে প্রতিদিন তিন বেলা যদি বিরিয়ানী খেতে হয়, তখন আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। শিশুদের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটি ঘটে। অনেক পরিবারে ছোট শিশুকে তিন বেলা খিচুড়ি দেওয়া হয়, যার ফলে শিশু বিরক্ত হয়ে যায়। প্রতিদিন একই খাবার না দিয়ে মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন আনলে, এই সমস্যা আর থাকে না।
নতুন খাবারে শিশু আগ্রহ নাও দেখাতে পারে, কারণ খাবারের গন্ধ ও স্বাদ তার কাছে অপরিচিত। শুরুতে শিশুর মুখে না দিয়ে, তার সামনেই আপনি নিজে একটু খান। তারপর তার মুখে অল্প পরিমাণ তুলে দিন, যেন সে স্বাদ নিতে পারে। এভাবে আস্তে আস্তে তাকে নতুন খাবারে অভ্যস্ত করবেন। তবে যে খাবারে শিশুর অরুচি বা অনীহা আছে, সেখানে এই পদ্ধতি কাজ হবে না, উল্টো শিশু বিরক্ত হবে। ‘একটু খাও’ এই বলে যদি শিশুর সাথে চাপাচাপি করি, তাহলে খাবারের প্রতি অনীহা আরো বেড়ে যায়।
নেতিবাচক কথাও শিশুর মধ্যে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি করতে পারে। বাসায় মেহমান আসলে সবার সামনে যদি বলেন- আমার বাচ্চা খায় না, এতে শিশুর আত্মসম্মানে লাগে। প্রতিশোধ হিসেবে শিশুও খাবারের প্রতি অনীহা আরো বাড়িয়ে দেয়।
কার্টুন অথবা মোবাইলে গান দেখে শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস করলে, স্ক্রিন দেখা ছাড়া শিশু খেতে চায় না। এতে হজমেরও ব্যাঘাত ঘটে। মনোযোগের সহিত খাবার না গ্রহণের ফলে পাকস্থলিতে অনেক প্রয়োজনীয় এনজাইম ঠিকমত নিঃসরণ হয় না বলেই হজমের এই সমস্যা। মায়েদেরও উচিত শিশুদেরকে খাবার খাওয়ানোর সময় নিজেরা টিভি না দেখা এবং শিশুর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া।
মাঝে মধ্যে শিশু কম খেতে পারে। অসুস্থতা বা বদহজম হলে বড়দেরও মাঝে মাঝে এমনটি ঘটে। কোন খাবারের প্রতি অরুচি তৈরি হতে পারে, সেটা বেশ কিছুদিন স্থায়ীও হতে পারে। সব সময় খাবারে একই রুচি থাকে না। বিষয়টি সাময়িক। রুচি ফিরে আসলে তা ঠিক হয়ে যায়।
খাবার গ্রহণ যেকোনো প্রাণীর মধ্যে স্বভাবজাত একটি বিষয়। শিশু না খেতে চাইলে তার সাথে জোরজবরদস্তি না করে অপেক্ষা করা উচিত। প্রশ্ন আসতে পারে কতক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত? উত্তর হলো যতক্ষণ খাওয়ার আগ্রহ না দেখাবে। আসলে প্রাণী মাত্রই খাবারের প্রয়োজন হবে। যখন ক্ষুধা লাগবে, তখন আপনাকে তার পিছনে ছুটতে হবে না, সে নিজেই আপনার পিছনে খাবারের জন্যে ঘুরঘুর করবে।
কিছু কৌশল আপনাকে পরিস্থিতি বুঝে নিতে হবে। খাবার প্লেটে একসঙ্গে বেশি খাবার দিবেন না, এতে নষ্ট করার সম্ভাবনা বেশি। প্রথমে শিশুকে তার চাহিদার তুলনায় কম দিন। যদি সে শেষ করে ফেলে তাকে বলুন- তুমি কী আরেকটু খেতে চাও? যদি শিশু আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে তাকে আরেকটু খেতে দিন। তিন বছর থেকে শিশু খেতে চাইলে সাথে সাথে না দিয়ে, একটু অপেক্ষা করতে বলুন। এতে খাবারের প্রতি শিশুর আগ্রহ বাড়বে, পাশাপাশি বাড়বে ধৈর্য্যশক্তি।
এরপরেও যদি শিশু না খেতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে শিশুর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে। এটা বোঝার ভালো উপায় হচ্ছে বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন না বাড়া। মাঝে মধ্যে শিশুর পেটে গ্যাস হলেও শিশু খেতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
লেখক : প্যারেন্টিং গবেষক
পিডিএসও/এমএ