মোনায়েম সরকার

  ১৭ মার্চ, ২০২৩

মহানায়কের শুভ জন্মদিন আজ

ছবি : সংগৃহীত

আজ ১৭ মার্চ, ২০২৩ সাল। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন। বাংলার মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার জন্মদিন ঘিরে দেশ-বিদেশে নানামুখী কর্মকাণ্ড গৃহীত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনিভাবে সম্মানিত হচ্ছে উদীয়মান বাংলাদেশের গণমুখী কার্যক্রম। যে মহামানবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারত না, তাকে ঘিরে একটু অন্যরকম আনন্দ-উৎসব হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বৃদ্ধি পেলে বাঙালি জাতিও সম্মানিত হয়। কেননা বঙ্গবন্ধুর লড়াই-সংগ্রামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির জীবনমান উন্নতকরণ। নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা হিসেবে, জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্ব চিরদিন বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ পরিচয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর এ পরিচয়চিহ্ন মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম কোনোদিনই মুছে যাওয়ার নয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন ক্রমে ক্রমে সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য আনন্দঘন উৎসবে পরিণত হচ্ছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মৌখিকভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করার প্রস্তাব উত্থাপন করি। আমার প্রস্তাব ছিল ২০১৯ সালের ১৭ থেকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছরব্যাপী জন্মোৎসব পালন। কিছুদিন পরে প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবের সঙ্গে তার নিজের কিছু পরিকল্পনা যুক্ত করে তিনি এটাকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। এর ফলে দুটো সুবিধা হয়েছে, একটি হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন, অন্যটি হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন। এ দুটি বিষয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যে চিন্তা থেকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছেন এবং যে সময় তিনি নির্ধারণ করেছেন (২০২০-২১) তা যথার্থই হয়েছে।

শেখ মুজিব আজ শুধু আর বঙ্গবন্ধু নন, তিনি এখন বিশ্ববন্ধু। তার চিন্তাচেতনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা পৃথিবীর মানুষকে চমকিত করেছে, তার মতো সাহসী ও আপসহীন নেতা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন ইউএনও, ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ১২ ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর নামে শান্তিপদকও ঘোষণা করেছে। ইউনেসকো বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধুর নামে শান্তিপদক ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই আমি বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু শোষিত মানুষের পক্ষেই লড়াই করে গেছেন। এ কারণেই তিনি বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিককে যুক্ত করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ই নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই এ কথা ভেবেছিলেন। এজন্যই তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলা সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলা হয়ে উঠত। ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সেই সুযোগ না দিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এর ফলে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ, মুখ থুবড়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার প্রদর্শিত পথেই নিরলসভাবে হেঁটে চলেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশ সর্বদিক থেকেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ৯ লাখ গৃহহীন পরিবারকে গৃহপ্রদান করে প্রধানমন্ত্রী একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছেন। বাংলার মানুষ না খেয়ে থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না, তারা ভাত-কাপড়-বাসস্থান সবকিছুই পাবে তাদের মুখে এক দিন হাসি ফুটবে এমন স্বপ্নই খেলা করত বঙ্গবন্ধুর চোখে। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারলেও তার কন্যা বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ধীরে ধীরে সম্পন্ন করছেন। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ কথা বলাই যায়, লড়াকু বাঙালি জাতিকে আর দাবায়ে রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

বঙ্গবন্ধু আমাদের দিশারি। বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে আমরা সৎ হতে পারি, সচেতন হতে পারি, দক্ষ কর্মী ও দেশপ্রেমিক হয়ে দেশকে গড়ে তুলতে পারি। এ কথা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধুই আমাদের ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধুই আমাদের ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধু আমাদের মঙ্গলের জন্য, দেশের কল্যাণের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে যদি আমরা এ দেশে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদি এ দেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবেই বঙ্গবন্ধুর আত্মদান সার্থক হবে। আর এ কার্যসাধনে বঙ্গবন্ধুর অমলিন স্মৃতিই হবে আমাদের পথপ্রদর্শক। আজ যদি আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাই, তার আদর্শ থেকে বিস্মৃত হই, তবে যে জাতি হিসেবেই আমাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়বে তা-ই নয়, পৃথিবীর জন্যও তা এক মহাক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেসব বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যই শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয়।

এত দিন আমাদের মুজিবপ্রেম ছিল অনেকটা লোকদেখানো বিষয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তা মননে ঢুকতে শুরু করেছে। এটি শুভ লক্ষণ। আগে বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শাহাদত দিবসে নেতাকর্মীরা মাইক বাজাত, তোরণ বানাত আর খিচুড়ি খেত, এখন এ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রচনা প্রতিযোগিতা, কুইজ ও নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। আজ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’। তার এবং স্বাধীনতার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে নানা রকম ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ, যেমন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্লাসটাওয়ার, শিখা চিরন্তন, বঙ্গবন্ধু মুজিবের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সমাধির যে চেহারা ছিল আজ তা নেই। তার বাড়ির ভাঙা দরজাও আজ বদলে গেছে। এ ছবিগুলো আছে ‘হু কিলড মুজিব’ আর ‘বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’ গ্রন্থে। ছবিগুলো সে সময় দিল্লিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত দিয়েই ‘হু কিলড মুজিব’ গ্রন্থের লেখক এএল খতিবের (আবদুল লতিফ খতিব) হাতে পৌঁছেছিল। ছবিগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমারও কিছু ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমাদের শুধু এখানেই তৃপ্তির ঢেকুর তুললে হবে না, আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কর্মীরা কেউ মাথায় পাগড়ি বেঁধে ফেরিওয়ালা হয়ে পালিয়েছিল, কেউ স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হয়েছিল ঘরের মধ্যে বসে থেকে। আমার ভয় হয়, আবার যদি ১৫ আগস্টের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে? আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা নিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন।

আজকের সভ্য মানুষ সম-অধিকারে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি চাচ্ছে শান্তিপূর্ণ সুখী জীবন। একটি শান্তিপূর্ণ জীবন পেলে, সার্বিক নিরাপত্তা পেলে ব্যক্তিমানুষের আর কোনো আকাক্সক্ষা থাকে না। জোর করে কোনোকিছু চাপিয়ে দিয়ে প্রগতিকে রোধ করা যায় না। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্ব এগিয়ে যাবে, তবে নতুন বিশ্ব কোন্ পথে চলবে, নতুন দিনের সমাজতাত্ত্বিকদের সেই কথাটাই ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে যুক্তিকেই মূল্য দিতে হবে। পৃথিবী অতীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে, ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের কাল্পনিক কাব্যকথা শুনতে মানুষ রাজি নয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা ও আইনের শাসন কামনা করছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই গড়ে তোলা সম্ভব হবে আগামী দিনের সুখী, সমৃদ্ধিশালী, সুন্দর পৃথিবী।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাঙ্ক্ষিত মহামানব যখন ধরণির বুকে পদার্পণ করেন, তখন দিকে দিকে রোমাঞ্চ সঞ্চারিত হয়, মর্ত্য-ধূলির ঘাসে ঘাসে জাগে প্রাণপ্রবাহ। বাংলার মহাকালজয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মমুহূর্তেও নতুন করে সেজেছিল বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি। তার আবির্ভাবে নিপীড়িত বাংলা পীড়ন থেকে মুক্তি পায়, স্বাধীনতার আনন্দে উদ্ভাসিত হয় বাংলার উর্বর প্রান্তর। যে মহামানবের আপসহীন সংগ্রাম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব বিশ্বের বুকে নতুন পরিচয়ে বাঙালিকে পরিচিত করে, শুভ জন্মতিথিতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মহানায়ক,শুভ জন্মদিন,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close