ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ১৫ মার্চ, ২০২৩

ভোক্তাকে আইন সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে

ছবি : সংগৃহীত

আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ভোক্তা অধিকার দিবস। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। এ অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু সে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে।

১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ভোক্তার চারটি অধিকার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেন। এগুলো হলো নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ অধিদপ্তর। একটি দেশে নাগরিকদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় নাগরিক অধিকার। আর এ নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম। একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন। যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা।

একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হলো মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।

পণ্য ক্রয়ে প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এমনকি শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার দরুন প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায়, বর্ণিত গুণাগুণ সেই পণ্যের মধ্যে নেই। তাই ভোক্তাকে এই আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ করতে হবে। তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে। আর ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। আমি ভোক্তা অধিকার আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্য করা মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।

পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। গুগোল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ করা যায়। আর ২০০৯ সালের আইনটি হওয়ার আগে কমবেশি ৪০টি আইন ও ধারা বিচ্ছিন্নভাবে ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে সবগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয় একসঙ্গে করা হয়।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে আরো যে কটি উল্লেখযোগ্য আইন আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫, অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন ১৯৫৬, নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯, পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০, ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ ও এক্রেডিটেশন বোর্ড আইন ২০০৬। সবগুলো আইনেই ভোক্তা অধিকারের কথা বলা আছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। তারা বহুদিন থেকেই এ ধরনের আইন বাস্তবায়নের সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠত বিষয়। ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা দাম দিয়ে ভেজাল পণ্য ও সেবা ক্রয় করি। এ নিয়ে নাগরিকরা কোনো প্রতিবাদ করে না। রাষ্ট্রও নির্বিকার। কিন্তু অন্যান্য দেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের কথা ভাবাও যায় না। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করলে অনেক দেশে বিক্রেতার লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। শুধু তাই নয়, আছে ফৌজদারি দণ্ডও। তাই আইনের বাস্তবায়নটাই বড় কথা।

যেকোনো দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের মাঝে অর্থাৎ ভোক্তাদের মাঝেই সে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে। মিথ্যাচার, ভেজাল, ফর্মালিন আজ ভোগ্যপণের সঙ্গে মিশে গেছে। এমনকি ওষুধ দিয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। বাজারের শাকসবজি, ফল-মূল সবকিছুতেই ফরমালিন।

আইন প্রণয়নের পর বিভাগ, জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় বাজার মনিটরিং ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এ লক্ষ্যে মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে অভিযান পরিচালনার সংবাদ দেখা যায়। এটিকে আংশিকভাবে এ আইন বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু জনগণের দোরগোড়ায় এ আইনকে পৌঁছে দিতে হবে। সচেতন করতে হবে সবাইকে।

পরিশেষে, আমাদের শিকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে যে কটি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির আওতার মধ্যে রয়েছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যদিও তাদের লোকবল অনেক কম তার পরও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটু আলাদা। আশা করি তারা তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি ধরে রাখবে এবং মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে।

লেখক : হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভোক্তা,ভোক্তা আইন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close