মোহাম্মদ অংকন

  ১১ মার্চ, ২০২৩

ধুলোয় ধূসরিত ঢাকা

ছবি : সংগৃহীত

শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, বসন্তের শুরুতে কড়া রোদ থাকায় রাস্তায় ধুলোর উৎপাত অনেকাংশে বেড়ে যায়। টানা কয়েক মাস আদৌ বৃষ্টি না হওয়াই মূলত ধুলোর উৎপাত বৃদ্ধির আসল কারণ। একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ধূলিঝড় শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের কান, নাক, মুখ ও চুলে প্রবেশ করেই ক্ষান্ত হয় না এই ধুলো; বাসাবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহনের দিকে তাকালে ধুলোর যে স্তর লক্ষ করা যায়, তা অবিশ্বাস্য। এত ধুলো জমল কোত্থেকে!

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী শহরে ধুলোর উৎপাত অসহনীয়। এ যেন ধুলোর শহর ঢাকা রে! প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মাণসহ নানা কারণেই বিভিন্ন বালিকণা বাতাসে মিশে ধুলোতে পরিণত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, যানবাহনের চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে বালিকণা মিহি ধুলোতে পরিণত হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব ধুলো যে স্বাস্থ্যের জন্য কতটা মারাত্মক, তা শুধু বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষজনই উপলিব্ধ করতে পারছে।

রাজধানীতের চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষ ও পরিবহন চলাচল করে। এ সময় অনিয়ন্ত্রিত ধুলো পথচারীদের শরীরে প্রবেশ করে নানা রকম রোগবালাইয়ের জন্ম দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের কাশির সঙ্গে বের হয়ে আসছে সেই ধুলো। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিসহ ধুলোবাহিত নানা রোগে প্রতিনিয়ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন মানুষজন। জীবন-জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে, এর চেয়ে মারাত্মক বিষয় আর কী হতে পারে। যে শহরে আয়-রোজগার করে মানুষ নিরাপদে বসবাসের উপায় খুঁজছে, সেই শহরের বাতাসে বয়ে বেড়ানো ধুলো মানুষকে অসুস্থ করতে তুলছে। এ বড়ই দুঃখজনক!

শুধু চলাচলের রাস্তাতেই এসব ধুলো সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতের ছাদ ও আসবাবপত্রের দিকে তাকালে দেখা মেলে ধুলো তার অবস্থান কতটা জোরালোভাবে তৈরি করে ফেলেছে। এক দিন আসবাবপত্র পরিষ্কার না করলে পরের দিন তা আর ব্যবহার উপযোগী থাকছে না। শুধু আসবাবপত্রই না, ব্যবহৃত পোশাকপরিচ্ছদ প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করতে হচ্ছে শুধু ধুলোর আস্তরণ পড়ার কারণে। এক দিনের পরা পোশাক-আশাক পরের দিন পরার কোনো জো নেই। প্রতিদিন পোশাকপরিচ্ছদ পরিষ্কার করতে সাবানবাবদ যেমন মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনি ঘনঘন পরিষ্কারের কারণে পোশাকপরিচ্ছদ দ্রুততম সময়ে ক্ষয় হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক ধুলো স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ নানাভাবে শহরের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা কি কেউ ভেবে দেখছে?

রাজধানীতে ধুলো নিয়ন্ত্রণে আনা খুব জটিল কোনো বিষয় বলেও মনে হচ্ছে না। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে ধুলোগুলো বাতাসে ওড়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেহেতু দ্রুতগতিতে কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তত রাস্তার ধুলো খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যাই হোক, নগরে ধুলোর আধিক্য বিচারে আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত আশা করি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল। তাই যে জনগণ সরকারকে কর প্রদান করে, তাদের নিরাপত্তা বিধান করা প্রতিনিধিদের দায়িত্ব। দৃশ্যমান ধুলো যখন মানুষকে মহামারির মতো অসুস্থ করতে শুরু করবে, তখন কি তাদের টনক নড়বে?

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেহেতু নিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, নির্মাণজনিত কারণে যেহেতু শহরে ধুলো ক্রমেই বাড়ছে, সেই চিন্তাবোধ থেকে ধুলো প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে নাগরিকদের অন্যতম চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাত নিয়মিত হলে ধুলো নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না বলে বৃষ্টিহীন সময়ে রাস্তায় পানি ছিটানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে না, তা কেমন বিষয়!

বিশ্বের মরুপ্রবণ অনেক অঞ্চলে ধুলোবালি পরিষ্কারের অত্যানুধিক মেশিন চোখে পড়ছে ইদানীং। সেসব যন্ত্র হয়তো এখনই আমাদের দেশে ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। তবে বাঙালি হিসেবে আমরা তো সব সময়ই বিকল্প চিন্তাধারা নিয়ে পথ চলি। সেই চিন্তা থেকে সকাল-বিকেল পানি স্প্রে গাড়িগুলো শহরের প্রতিটি রাস্তায় নামালে ধুলোর আধিক্যতা কমবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এজন্য প্রয়োজন নগর কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছা ও নাগরিকদের প্রতি ভালোবাসা। জনগণের ভোট নেওয়ার পর নির্বাচিত হয়ে চেয়ারে বসে জনগণের ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করা হবে না, এমন প্রতিনিধি হয়তো কেউই প্রত্যাশা করে না। পরিমিত বাজেট ও নির্ধারিত লোকবল থাকলে ধুলোর মৌসুমে ধুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, এটা বুঝতে নগর-পরিকল্পনাবিদ হতে হয় না কাউকে।

আমরা প্রত্যাশা করব, রাজধানীর জনসাধারণকে সুস্থ রাখার অভিপ্রায়ে, বায়ুদূষণ প্রতিরোধে, নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সিটি করপোরেশনসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করবে। নচেত দিন-দুপুরে মানুষ যেমন মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জীবনযাপন করে, তার ওপর আবার যদি ধুলো কানে-মুখে-শরীরে প্রবেশ করে অসুস্থ করে তোলে, তবে এ যে কৃত্রিম মৃত্যুর নামান্তর। আমরা সমাধানের উপায় চোখে দেখছি, কিন্তু সেটা প্রয়োগ করা হচ্ছে না, এটার ব্যর্থতার দায়ভার কে কাঁধে নেবে? দূষণের কবলে পড়ে অতিষ্ঠ নাগরিক-জীবন থেকে মুক্তির কোনো পথ কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। এমন অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টিপাত প্রার্থনা করা ছাড়া বিকল্পও দেখছি না।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত।

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধুলোয় ধূসরিত ঢাকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close