হানজালা শিহাব
বিশ্ব ক্যানসার দিবস ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
১০ বছর আগে ফেব্রুয়ারিতেই ক্যানসারে মা হারিয়েছি। ক্যানসারে মারা গেছেন ছোট মামাও। এখন ক্যানসারের সহযাত্রী আমি। গত বছর জুনে আমার রেক্টামে (মলদ্বার) কোলন ক্যানসার শনাক্ত হয়। এরপর ৮ মাসে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে। বাধ্য হয়েছি পত্রিকায় সংবাদ ছেপে মানবিক সহায়তা চাইতে। জানি না, শেষ পরিণতি কী অপেক্ষা করছে!
২০১৬ সালে ফ্রান্সে প্রথম ৪ ফেব্রুয়ারি ক্যানসার দিবস পালিত হয়। ২০২০ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে ৪ ফেব্রুয়ারি ক্যানসার দিবসটি বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। আমার কাছে এবারের দিবসটি ভিন্ন রকম আবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।
আমি একজন ক্যানসারের রোগী। আমার মতো দেশে আরো কয়েক লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। ওইসব নারী-পুরুষের কষ্টের কথা বলার হয়তো সুযোগও নেই। তাদেরই একজন বিলকিস বেগম (৫৮)। বাসা ঢাকার ডেমরার তারাবো উত্তরপাড়ায়। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। ৬ মাস আগে তার গলায় টিউমার দেখা দেয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ক্যানসার শনাক্ত হয়। বিলকিস বেগমের স্বামী ছিলেন বাসচালক। আগে থেকেই তিনি ছিলেন হার্টের রোগী। স্ত্রী ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে রোগে-শোকে এক মাস আগে স্বামী মারা যান। টানাপড়নের সংসার বিলকিস বেগমের। চিকিৎসকরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিলেও তা সম্ভব হয়নি। ঢাকা মেডিকেলের ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রই তার শেষ ভরসা।
এরই মধ্যে তিনি কেমোথেরাপির তিনটি ডোজ নিয়েছেন এখানে। একটি ডোজের ওষুধ হাসপাতাল থেকে ফ্রি পেলেও বাকি দুটি কিনতে হয়েছে। এখন রেডিওথেরাপির জন্য ঘুরছেন সিরিয়াল পেতে।
৩০ জানুয়ারি ঢামেকের রেডিওথেরাপি বিভাগে তার সঙ্গে কথা হয়। বিলকিস বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়া আর চিকিৎসার নানা কাহিনী শোনান। বিলকিস একাই নন। একই সময় সেখানে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন শতাধিক ক্যানসার রোগী ও তাদের স্বজনরা। প্রত্যেকেই নানাভাবে ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কারণ ঢামেকে রেডিওথেরাপির জন্য দুটি মেশিন থাকলেও দীর্ঘদিন একটি নষ্ট। দ্বিতীয় মেশিনটি বেশ পুরোনো। ১৯৯০ সালে কেনা মেশিনটি দিয়ে প্রতিদিন শত শত ক্যানসার রোগীর থেরাপি দেওয়া বাস্তবেও সম্ভব নয়। ফলে সঠিক সময় প্রত্যাশিত চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক ক্যানসার রোগী।
আমার রেক্টাম ক্যানসার শনাক্তের পর বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন ও কেমোথেরাপি নিয়েছি। এখন রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। এজন্য ঢামেকে যেতে হয়েছে। দুই সপ্তাহ হলো, থেরাপির সিরিয়াল পাইনি। কবে পাব তাও বলা কঠিন। বলা হচ্ছে, মার্চ-এপ্রিলের আগে সিরিয়াল দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ব্লাডে দ্রুত ক্যানসারের জার্ম বাড়তে থাকা একজন রোগী বিনা চিকিৎসায় সেই পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন- এ নিশ্চয়তা কে দেবেন!
শুধু ঢাকা মেডিকেল নয়, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চিত্র আরো ভয়াবহ। প্রতিদিন সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো ক্যানসার রোগী ভিড় করছেন। এত রোগীর চিকিৎসা বা থেরাপি দেওয়ার সক্ষমতা নেই প্রতিষ্ঠানটির। সেখানে একজন রোগী ভর্তির সিরিয়াল পেতে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। ফলে চিকিৎসার আওতায় আসার আগেই কোনো কোনো রোগীর পরিণতি হয় ভয়ানক।
দেশে ক্যানসার রোগী ও তাদের পরিবারের ভোগান্তির এ হচ্ছে খণ্ডচিত্র। একদিকে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় রোগীসহ স্বজনরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে চিকিৎসা করতে গিয়ে বাড়তি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেই আজ দেশে বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালিত হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যদি সেবার মান উন্নত করা না যায়, ক্যানসার চিকিৎসায় সরকারি বরাদ্দ ও বাজেট না বাড়ে, শুধু দিবস পালন তাদের কোনো উপকারে আসবে না।গবেষকরা বলছেন, দেশে প্রতি ১ লাখে ২৬০ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। ঠিকমতো উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সালে প্রতি লাখে ১ হাজার ১৫০ জন মারা যেতে পারে। বাংলাদেশে ৬০ ভাগ ক্যানসার রোগী প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না ক্যানসার চিকিৎসার পরিধি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফিজিশিয়ান ডা. মুজিবুল হকের মতে, আপনি যদি প্যাকেটজাত খাবার, কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড, পোড়া মাংস, সয়াবিন তেল, ডুবন্ত তেলে ভাজা খাবার, সাদা চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার, ফার্মের মুরগি, চাষের মাছ এবং ফরমালিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন তাহলে এগুলো শরীরে জমে এক সময় আপনি অসুস্থ হবেন, এটা নিশ্চিত। হয় ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন, নয়তো কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস- কোনো না কোনো রোগ হবেই। তা আজ হোক আর কাল হোক। বাস্তবে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক প্রতিনিয়ত এ জাতীয় খাবার আমরা গ্রহণ করছি এবং এসব দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তও হচ্ছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। তবে নিরাপদ খাদ্য এখনো নাগালের বাইরে। গত ২ ফেব্রুয়ারি দেশে নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হলো। বাস্তবে ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য সাধারণ মানুষের জন্য এখনো সুদূর পরাহত। ফলে দেশে এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ ক্যানসার, হৃদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ দূরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। এ থেকে মুক্তি পেতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হওয়া জরুরি। একইসঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা, দূষণমুক্ত পরিবেশে থাকা অতীব জরুরি। পাশাপাশি আক্রান্তদের জন্য কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সহজলভ্য করতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো, প্রয়োজনীয় জনবল এবং চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা।
লেখক : সাংবাদিক [email protected]