অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

  ০৭ নভেম্বর, ২০২২

সাত নভেম্বরের প্রকৃত ইতিহাস

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর সুস্থ, মানসিক ও সৃজনশীল বিকাশের জন্য প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাস তথা কোনো বিষয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সব ঘটনাগুলো রয়েছে সেগুলো জানা থাকলে সুনির্দিষ্ট ভবিতব্য তথা দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে জানা সহজতর হয়। সেক্ষেত্রে অভিভাবক ও সচেতন মহলের দায়িত্ব থাকবে নতুন প্রজন্মের নিকট তথা আগামী দিনের ভবিষ্যতের নিকট সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। তেমন একটি বিষয় হলো ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত বিতর্কিত দিন ৭ নভেম্বর।

১৯৭৫ সালে সংগঠিত এদিনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে যে ওলটপালট করে দেয় তার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশের রাজনীতি। ৭ নভেম্বর অনেকের কাছে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস, অনেকের কাছে সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থান দিবস আবার অনেকের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে তৃতীয় দিবসের প্রতিই রায় দেয়। তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে বিএনপি, যা জাতির সঙ্গে একটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেদিন কোনো বিপ্লব হয়নি, আর জনগণের সংহতির তো প্রশ্নই নেই। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হায়দারসহ বহু সৈনিক ও অফিসারকে হত্যা করা হয়। বহু সৈনিক ও অফিসারদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে এইদিন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে এই হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়েই বিএনপি নামক দলটির জন্ম হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উৎখাত করার লক্ষ্যে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান হয়। আগেই মোশতাক-জিয়া চক্র বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জাতীয় চার নেতাই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে। সে আশঙ্কা থেকে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের আগের সে আশঙ্কা থেকে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের আগের রাতেই মীরজাফর মোশতাক গং জিয়া-ফারুক রশিদরা রাতের অন্ধকারে মানব সভ্যতার ইতিহাসের আরেক জঘন্যতম বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরিকল্পিতভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে চার জাতীয় নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়ে খন্দকার মোশতাককে গ্রেপ্তার করেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক-রশিদ-ডালিমরা থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়। কিন্তু জাসদ ও তাদের নেতা কর্নেল তাহেরের হঠকারী সিন্ধান্ডে ৭ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়াকে যুক্ত করে। হত্যা করা হয় সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার ও সাব-সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডারও নিহত হননি। অথচ ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে শেরেবাংলা নগরে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে দুজন সেক্টর কমান্ডার, একজন সাব কমান্ডার ও ১৩ সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। মূলত এই হত্যাকাণ্ডের পরই জিয়াউর রহমান এককভাবে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

লেখক গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন কর্নেল শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেয়েও থেকে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু যখন বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। এতে তার পা ভেঙে যায় এবং পরে ধরা পড়েন। তার জায়গা হয় সামরিক হাসপাতালে। অবশ্য তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এর আগে ৬ নভেম্বর ভোর রাতে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অন্যতম ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিল এই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর অ্যাটিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে। পরে অবশ্য পদবি বদলিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গণভোট (হ্যাঁ-ভোট ও না ভোট), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও তার আমলে ২০টির বেশি অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়। এসব অভ্যুত্থানে অসংখ্য সামরিক সদস্য নিহত হন বলে জানা যায়। প্রায় প্রতি তিন মাসে একটি করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল জিয়ার শাসন আমলে বলেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।

১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের চরিত্রটাই বদলে দেয়। এই অভ্যুত্থানের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় দীর্ঘ অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন, গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেওয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনা সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা।

৭ নভেম্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই ঘটনায় লাভবান হয়েছে শুধু জিয়াউর রহমান এবং তার অনুসারীরা। আর পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। অগণতান্ত্রিকভাবে সেনা ছাউনিতে বিএনপির জন্ম। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে তারা দল গঠন করেছে। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানুষ এখন সঠিক তথ্য পাচ্ছে। মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না। বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানকে আর নায়ক বানানো যাবে না, বাঙালির ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী খলনায়ক হিসেবে স্থান পাবে।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় রাজনীতি,৭ নভেম্বর,কর্নেল হায়দার,কর্নেল হুদা,সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close