আ ন ম  মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২১ অক্টোবর, ২০২২

কৃষিতে নয়, কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া হোক

ছবি : সংগৃহীত

মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত। এজন্যই মানব কল্যাণ নিশ্চিত করতে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষ চিন্তা করে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে অর্ধশতাব্দী আগে, গত বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এই ৫০ বছরে যা পেয়েছি তা সীমার মধ্যে অসীম বটে। কিন্তু তারপরও পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড আমাদের পরিবেশ, খাদ্য ও জনস্বাস্থ্যকে মহাসংকটে ফেলছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী দিয়ে স্বাধীনতার পরের হাফ সেঞ্চুরিতে বহু বিলিয়ন কিউসেক লিটার পানি গড়িয়েছে। একাকী চুপচাপ বসে থাকলে মনে মনে অনেকেরই ভাবনার উদয় হয়। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরিয়ানরা দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। সব নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। ওদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, আর এটা সম্ভব হয়েছে ওদের যোগ্য নেতৃত্বের গুণ, দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ সিভিল সার্ভিস ও কলুষতাহীন রাজনীতির কল্যাণে।

একটি দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম, যা মানুষের জন্মগত অধিকারও বটে। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সব থেকে ভালো ভ্যাকসিন খাবার। সামাজিক রূপান্তর থেকে শুরু করে উন্নয়ন এবং বিস্তারের কাজে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে খাদ্য। একটি সুস্থ জীবনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন। বৈচিত্র্যময় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা অনেক ধরনের খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারি। আর খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের কাজ করে। তবে খাদ্যের সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যদি কৃষিকে বাদ রেখে আমরা খাদ্যের কথা বলি তবে বিষয়টি হবে অযৌক্তিক। খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকাই প্রধান। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ১ কোটির ওপর বসতবাড়ি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বসতবাড়িগুলো শুধুই আবাসস্থল নয় বরং একেকটি কৃষি, মৎস্য, পশু, হস্ত ও কুটির শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের দেশের আবাসস্থলগুলোতেই মূলত শাকসবজি, মসলাজাতীয় ফসল, ভেষজ, ঔষধি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, মৎস্য প্রভৃতি চাষাবাদ হয়ে থাকে, যেহেতু দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার প্রধান পেশা কৃষি। ১৯৯৬ সালে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন উল্লেখ করা হয়Ñ খাদ্য নিরাপত্তা তখনই আছে বলে মনে করা হয়, যখন সব নাগরিকের সবসময়ের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তির প্রত্যক্ষ ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকে, যা তাদের সক্রিয় ও সুস্থ জীবন নিশ্চিতকরণের জন্যে সঠিক পরিমাণ খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে।’

প্রবাদ আছে, বিপদ কখনো একা আসে না। কিন্তু এই প্রবাদের মধ্যে যে নিষ্ঠুর সত্যতা আছে, তা আমরা বেশ টের পাচ্ছি। বৈশ্বিক নানা সংকটের সময়ে জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে পুরো পৃথিবী। তারা কী করছে, কী বলছে, তা গুরুত্ব দেয়া হয় দিকনির্দেশনা হিসেবে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২৩ এপ্রিল ২০২০ সালে বলেছে, “করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। সর্বনাশা করোনা মহামারির ছোবল, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু বিপর্যয় ও বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসংকট ঝুঁকিতে বাংলাদেশও। বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো, এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশকে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে ও খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষিতে ভর্তুকি না দিয়ে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া হোক। কারণ কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান করলে লাভবান হয় সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, আর কৃষককে ভর্তুকি দিলে লাভবান হবে কৃষক। অর্বাচীন কোনো এক অদৃশ্য কারণে আমরা প্রতিনিয়ত কৃষককে ভর্তুকি না দিয়ে কেন যেন কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছি। স্বাধীনতার পরে সাত কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেখানে অসম্ভব ছিল, সেখানে কৃষকের কারণে এখন প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। কাজেই রাষ্ট্র যত বেশি কৃষিপণ্য (ধান, গম, ভুট্টা, অন্যান্য দানাদার খাদ্য ও সবজি ইত্যাদি) উৎপাদনে কৃষককে সরাসরি ভর্তুকি প্রদান করবে খাদ্য উৎপাদনও ততবেশি বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষককে ভর্তুকি প্রদান করলে, তখন কৃষক বেশি খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম হবে এবং জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারবে, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে। খরা, অনাবৃষ্টি, বালাই, আগাম বন্যা, পৃথিবীজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগুনে আমরা মরতে বসেছি। যাদের আমরা চিরকাল অবজ্ঞা করে এসেছি, সেই হতদরিদ্র কৃষকই এবারও এগিয়ে আসতে পারেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। এছাড়াও কৃষি পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ সংকট দূর করার পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতিতেও বিরাট অবদান রাখবে কৃষক। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজির) অন্যতম প্রতিপাদ্য : কাউকে পেছনে রাখা যাবে না। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক মানুষের কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতিকে বাদ দিয়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে রইল। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য এসডিজির অর্জনে কৃষি খাতে উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই, দারিদ্র বিমোচন এবং সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষকের অবদান অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই সব ধরনের বৈষম্য ও খাদ্যসংকট ঝুঁকি দূর করতে এখনই কৃষককে ভর্তুকি প্রদান করা হোক। কারণ ২৪ শতাংশ জিডিপির অধিকারী হয়েও দুবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ রুখতে পারেনি ভারতীয় উপমহাদেশ, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এবারও যদি কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষককে সরাসরি ভর্তুকি দিয়ে কার্যকর পদক্ষপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সামনে আসছে ১৪৩০-এর মন্বন্তর, যা ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য-বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু। যেখানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতিকে প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করা। কিন্তু তথাকথিত উন্নয়নের নামে কিছু লোক সম্পদশালী হচ্ছে এবং হয়তো আরো সম্পদশালী হবে। তবে জেনে রাখা দরকারÑ অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ উন্নয়ন মানব শরীরের ক্যান্সারের মতো। প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল কৃষক-শ্রমিকের, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই কৃষক-শ্রমিক, বেকার-হকারদের প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন হয়নি। যেখানে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মেহনতী এই কৃষক ও শ্রমিক মানুষকে শোষণ করছে কারা, তা ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশে হাতে গোনা কিছু মানুষের আয় কয়েক হাজারগুণ বাড়লেও সাধারণ মানুষকে মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার বাস্তবিক প্রমাণ হলো ২০২০ সালে এজন্য কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে জমিনের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কারণ ১ কেজি হাড়সহ গরুর মাংস কিনতে কৃষককে ১ মণ ৫ কেজি ধান বিক্রয় করতে হয়।

২০২২ সালে বোরো মৌসুমে ধান কাটা শ্রমিকদের আকাশচুম্বী মজুরির কারণে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকায় কৃষক। ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক পাওয়া যেন তাদের কাছে হাতে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন একজন শ্রমিককে ১ হাজার ৪০০ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি তিন বেলা খাবার দিতে হয়। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা প্রতি একর জমির ধান কাটতে ২০-২৫ হাজার টাকায় চুক্তি করছেন। শ্রমিকরা উচ্চ মজুরি হাঁকানোয় কারণে নিরীহ কৃষকের কণ্ঠে বেশি অসহায়ত্ব ধরা পড়ে। বোরো মৌসুমে কৃষক পাকা ধান মাঠে রেখে ঝড়-তুফান ও শিলাবৃষ্টির শঙ্কা দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছেন। প্রতি একরে ধান উৎপাদন হতে পারে ৫০ থেকে ৬০ মণ। ধানকাটা মৌসুমে বাজারে মণপ্রতি ধানের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

সম্প্রতি ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি ৫ আগস্ট ২০২২ মধ্যরাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যার কারণে কৃষি খাতে এবার সেচের খরচ আরো বাড়বে। সে হিসাবে ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আরো অসহায় হয়ে পড়বে। কিন্তু কৃষি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যৌক্তিকভাবে না বাড়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে কৃষকের অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। যদিও তার বহু বছর আগেই মানুষের বৈষম্য দূর করতে ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ২৮ আগস্ট ১৯৬৩ মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘আই হেব এ ড্রিম (আমি স্বপ্ন দেখি)। একদিন এই জাতি জাগবে এবং বাঁচিয়ে রাখবে বিশ্বাস। আমরা এই সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ গ্রহণ করছি যে, সব মানুষ সমান।’

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কৃষিতে নয়,কৃষককে ভর্তুকি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close