আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২০ অক্টোবর, ২০২২

জীবন ও বই যেন এক সুতোয় বাঁধা

চলছে মাসব্যাপী ইসলামি বইমেলা। জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত এই মাসব্যাপী বইমেলায় পাঠকের আনাগোনা আশাজাগানিয়া। কেননা একটি ভালো বই জীবন উদ্যানে আলোর ফোয়ারার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বই মানুষের নির্লোভ বন্ধু। বই মানুষের অবসরের সঙ্গি। বই মানুষের চিত্তবিনোদনের নির্মল উপাদান। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার অনন্য উপায় হচ্ছে বই। কেননা বই হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক। বইয়ের সঙ্গে যার যত বেশি সম্পর্ক, তার জ্ঞানের পরিধি ততই সমৃদ্ধ। আর জ্ঞান হলো আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য নিয়ামত, যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ক। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৯)

মানবজীবনে বইয়ের অপরিসীম গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা বই হচ্ছে মানবসভ্যতার শেখর। শ্রেষ্ঠ প্রকাশ মাধ্যম। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ তার চিন্তাচেতনা ও অভিজ্ঞতার বিবরণ, লেখনীর মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে বিভিন্ন চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আর সেই চেষ্টা-প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় সফলতার জোয়ার এনেছে জোহানেস গুটেনবার্গের অক্ষর যন্ত্র। যখন থেকে (১৪৪০-৫০) এই অক্ষর যন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে, তখন থেকেই শুরু হলো বইয়ের এই দুরন্ত পথচলা। অতীত-বর্তমান, দূর-দূরান্তের দেশ আর কালের গণ্ডির দুস্তর ব্যবধান দূর হয়ে যায় বইয়ের মাধ্যমেই।

বই মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। এক শ মানুষ বন্ধুর চেয়ে একটি ভালো বই উত্তম বন্ধু। মানুষ বন্ধুর দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও বইয়ের দ্বারা সেই আশঙ্কা নেই। নেই প্রতারণার ছলচাতুরী। মানুষের বন্ধুত্ব ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ তাদের মধ্যে স্বার্থের আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে। কিন্তু বই তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বই শুধু দিয়েই যায়, বিনিময়ে কিছুই নেয় না। সুতরাং বিখ্যাত সেই আরবি প্রবাদটি বলাই যেতে পারে, ‘অখাইরো জালিদিন ফিজ জামানুল কিতাব।’ অর্থাৎ, সময়ের সর্বশেষ বন্ধু হলো বই। অতএব, বইকে শুধু বন্ধুত্বের উপমাই নয়, বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার আসনে সমাসীন করা প্রয়োজন।

মানবজীবনে বইপাঠের উপকারিতার শেষ নেই। বিজ্ঞান বলে, বেশি বেশি বই পড়লে মানসিক বিকারগ্রস্ততা দূর হয় এবং নৈতিক চেতনায় মানসিক প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে। বই মানুষের ঘুমন্ত মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে সুপ্ত প্রতিভা এবং নৈতিকতায় উজ্জীবিত করে। বইয়ের আরেক নাম আলোর ভুবন। বই মানুষের মন-মননকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে পৌঁছে দেয় সাফল্যের সোনালি দরজায়। পৃথিবীর জগদ্বিখ্যাত বরেণ্য ব্যক্তিদের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলোকিত করতে যে মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সে মাধ্যমটির নামই হচ্ছে বই। তাই তো রুশ ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক তলস্তয় মানবজীবনে বইয়ের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।’

এক কথায় মানবজীবনে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আর এই প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব অনুধাবন করার লক্ষ্যেই কল্যাণময় ধর্ম ইসলাম বইপাঠকে দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। শুধু সমর্থনই দেয়নি, দিয়েছে অতীব গুরুত্বও। বলা বাহুল্য, ইসলামের প্রথম বাণীই ছিল পাঠ প্রসঙ্গে। সেই শাশ্বত বাণীর প্রথম শব্দই ছিল ‘ইকরা’ যার বাংলা অর্থ ‘পড়ুন’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামের সঙ্গে বইয়ের রয়েছে ঐশী সুতোর টান। ইসলামি গবেষকদের দাবি, আরবি ‘ওহি’র বাংলা উচ্চারণ হলো ‘বহি’। আর বহি থেকে কালক্রমে শব্দটি ‘বই’-এ রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হলো ‘পঠন’। সে হিসেবে দেখা যায়, ‘ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা বইকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। বই হলো জ্ঞানার্জনের অন্যতম মাধ্যম। আর ইসলামের পরিভাষায় জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর আবশ্যক।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪) জ্ঞানার্জনের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা আমার প্রতি ওহি করেছেন, যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জনে কোনো রাস্তা অবলম্বন করে, আমি তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিই।’ (বাইহাকি, শু’আবুল ইমান : ৫৩৬৭) অপর হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ইলমের (জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সবকিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্তও।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ২৮৭৩৭)

এ কথা তো সবাই এক বাক্যেই মেনে নেয় যে, সৃজনশীলতায় বইপাঠ অতুলনীয়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ পৃথিবীতে বইয়ের বিকল্প অন্য কিছু চিন্তাই করতে পারে না। মননশীলতা বা সৃষ্টিশীলতা যাই বলি না কেন, এর সবকিছুই সমৃদ্ধ হয় বইপাঠের মাধ্যমে। তাই একজন আদর্শ লেখক সৃষ্টিতে বইয়ের রয়েছে অনস্বীকার্য ভূমিকা। সেজন্যই আল্লামা জাইনুল আবিদিন দা. বা. বলেন, ‘তুমি যদি এক পাতা লিখতে চাও, তাহলে তুমি পঞ্চাশ পাতা পড়ো।’ লেখার স্থায়িত্বকে অমরত্ব দিতে হলে অবশ্যই বেশি বেশি বই পড়তে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেকক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার একটি লেখায় বই পড়া নিয়ে বলেছেন, ‘আমাকে মাঝে মাঝেই অনেকে জিজ্ঞেস করে, ভালো লেখক হওয়ার কোনো একটা শর্টকাট পদ্ধতি আমার জানা আছে কি না। আমি সব সময়ই বলি, ভালো লেখক হওয়ার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে বই পড়া। যে যত বেশি বই পড়বে, সে তত ভালো লিখতে পারবে। আমি এটা জোর দিয়ে বলি, কারণ আমাদের পরিবারের হুমায়ূন আহমেদ এ দেশের একজন অসাধারণ লেখক ছিল, আর সে একেবারে শিশু বয়স থেকেই শুধু বই পড়ে আসছে। আমার মনে হয় সেজন্যই সে এত সুন্দর লিখতে পারত।

একটা সময় ছিল যখন লাইব্রেরিগুলোতে লেগে থাকত পাঠকের উপচে পড়া ভিড়। অথচ এখন অধিকাংশ লাইব্রেরিই পাঠকশূন্য। এর অন্যতম কারণ, প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির অপব্যবহারে দিন দিন কমছে বইয়ের পাঠক। হাতেগোনা যে কজন পাঠক আছেন, তাদের অধিকাংশই শ্রেণি-পাঠের পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো বইয়ে হাত দিতে চান না। আর যারা চান, তাদের অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির গল্প-উপন্যাসের পাঠক। অথচ এসব বটতলার কুরুচিপূর্ণ বইয়ে নিজেকে গড়ার মতো শেখার কিছুই নেই। বরং এসব অশ্লীলতার সহজলভ্যতায় নষ্ট হচ্ছে সভ্যতা ও সামাজিক মূল্যবোধ। অধিকতর এসব বইয়ের দ্বারা আলোর ভুবনের পরিবর্তে তরুণ প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের অতল গহ্বরে।

মনে রাখা প্রয়োজন, সব মানুষ যেমন ভালো মানুষ হয় না, তেমনি সব বইও ভালো বই হয় না। যদিও এতে বই সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কারণ, বই তো আর নিজে নিজেই রচিত হয়নি। মানুষই এর রচিয়তা। বই মানেই তো মানুষের চিন্তাভাবনা, গবেষণার লিখিত ও মুদ্রিত নিযার্স। সুতরাং খারাপ মানুষরাই একে খারাপ করেছে। তবে ভাষার জাদুকরী প্রভাব বলেও একটা কথা আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ভাষাশৈলীতে জাদু রয়েছে।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫১৪৬) তো এই প্রভাবকে অস্বীকার করব কীভাবে?

সব মানুষের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব করা ঠিক নয়, তেমিন সব বইকেও সঙ্গী করা অনুচিত। এ প্রসঙ্গে শেখ সাদী (রহ.)-এর বহুল পরিচিত উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। তাই এই সর্বনাশের বিষক্রিয়া যেন আমাদের স্পর্শ করতে না পারে, সেজন্য আমাদের বই কেনার সময় বিচক্ষণ্নতার পরিচয় দিতে হবে। বই মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। করে ন্যায়-নিষ্ঠা ও নীতিবান। তাই মানবজীবনে বইয়ের গুরুত্ব অবশ্যই অপরিসীম। বলা যায়, জীবন ও বই যেন একই সুতোয় বাঁধা। ধসে পড়া সমাজব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করে সমৃদ্ধির পর্বতারোহণ আর ম্রিয়মাণ তারুণ্যকে শান্তির সবুজ অরণ্যে পৌঁছাতে চাই ভালো বইয়ের অধ্যয়ন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জীবন ও বই,এক সুতোয় বাঁধা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close